যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৫.
আঁধার আসমানে ভেসে আছে এক ধবধবে অর্ধ আকৃতির চিকন চাঁদ। সেই চাঁদের আশেপাশে জ্বলজ্বল করছে নক্ষত্রপুঞ্জিরা। একত্রে মিলে জানান দিচ্ছে আজ চাঁদ রাত অর্থাৎ আগামীকাল পবিত্র ঈদুল ফিতর।
চৌধুরী নিবাসের পুরুষেরা এক সঙ্গে বসে লিভিং রুমে খবর দেখতে ব্যস্ত। সাদিকা বেগম এবং জমিলা খালা মিলে আগামীকাল যা যা রান্না করবেন তা আজ রাতেই গুছিয়ে রাখছেন। মধুমিতা ব্যস্ত বাহারি রকমের ডেজার্ট আইটেম বানাতে। রান্নাবান্নার ক্ষেত্রে এই কাজটা করতে মেয়েটা খুব উপভোগ করে। বিয়ে করে এই বাড়ির বউ হয়ে আসার পর থেকে সবসময় যে কোনো উপলক্ষেই ডেজার্ট বানানোর দায়িত্বটা সে অলিখিত ভাবে নিজের কাধে তুলে নিয়েছে।
পার্থ খবর দেখার মাঝে একবার আড়চোখে চারিদিকে চোখ বুলায়। তরীকে কোথাও দেখছে না সে। কোথায় গেলো? এতক্ষণ তো রান্নাঘরে আম্মার সাথেই ছিলো। ভাবতে ভাবতেই পার্থ উঠে উপরের দিকে হাঁটা ধরে।
নিজের রুমে নীরবে প্রবেশ করতেই দেখে বিছানায় বসা তরীকে। হালকা সোনালী রঙের একটা অরগাঞ্জা থ্রি পিস পড়ে আছে সে। মাথার চুলগুলো একটা ক্লাচার দিয়ে খোপা করে রাখা। হাতে থাকা মেহেদীর কোন দিয়ে বাম হাতের তালুতে কিছু একটা আঁকিবুঁকি করার চেষ্টা চালাতে ব্যস্ত সে।
পার্থ এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,
“ মেহেদি দিতে জানেন ম্যাডাম? “
তরী অসহায় মুখে পার্থর দিকে তাকিয়ে বলে,
“ এর থেকে সহজ তো আমার বায়োলজি প্র্যাক্টিকালের ড্রইং ছিলো। “
“ আগে কখনো ঈদে মেহেদী লাগাও নি? “
“ মাঝে মধ্যে সময় পেলে মেহেদি আর্টিস্ট বাসায় কল করে নিতাম। এসে সুন্দর করে ডিজাইন করে দিয়ে যেতো। “
“ তাহলে আজ ডাকো নি কেনো? “
“ খেয়াল ছিলো না। “
পার্থ তরীর পাশে বসে বলে,
“ সবসময় যে ডিজাইনই করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। চাইলে হাতের মাঝে গোল করে একটা বৃত্ত আর আঙুল ভরে মেহেদি লাগালেই পারো। ওটা আরো বেশি সুন্দর লাগবে। “
তরীর বুদ্ধিটা বেশ পছন্দ হয়। সে একটা টিস্যু নিয়ে হাতের এলোমেলো মেহেদীর ডিজাইন মুছে পার্থর কথা মতো লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পার্থ তার পাশে বসে একহাতে ফোন চালাতে চালাতে অপরহাতে তরীর ক্লাচার টেনে খোপা খুলে দেয়। সাথে সাথে তরী বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করে,
“ সমস্যা কি? “
পার্থ ফোনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই নিজের একহাতে তরীর চুলের গোছা পেঁচিয়ে ধরে বলে,
“ আমি তোমাকে বিরক্ত করবো না, তুমিও এখন আর আমাকে বিরক্ত করো না তো। “
তরী ফুসে উঠে সামনে ফিরে ফের হাতে মেহেদী লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই লোকের সাথে বেশি তর্ক করাও জ্বালা। সর্বদা বেশ শান্ত সেজে ঘুরে বেড়ানো এই অতিশয় ভদ্রলোক যে কতটা নির্লজ্জ তা তরী ছাড়া আর কেউ জানেনা। তাই আপাতত নিজের কাজে মনযোগ দেওয়াই উত্তম মনে করে সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বেডরুমের দরজায় নকের শব্দ হয়। পার্থ তরীর চুল ছেড়ে দিয়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। রুমে প্রবেশ করে শোভন ও মধুমিতা। মধুমিতার হাতে একটা ট্রে তে সবেমাত্র রান্না করা চার বাটি ফিরনি। তরী হাসিমুখে বলে,
“ গরম গরম খাবে নাকি? “
“ হ্যাঁ ভাবী। ছাদে চলুন। চাঁদ রাতে চাঁদ দেখতে দেখতে গল্পও করা হয়ে যাবে। “
তরীর কাছে প্রস্তাবটা ভালো লাগে। তার একহাতে মেহেদী দেওয়াও শেষ। অপর হাতে আরেকটা মেহেদীর কোন আর কিছু টিস্যু নিয়ে সে বিছানা থেকে নেমে বলে,
“ চলো। “
মধুমিতা পার্থর দিকে তাকিয়ে বলে,
“ দাদা আপনিও চলুন। চারজনের জন্যই ফিরনি নিয়েছি আমি। “
পার্থ মৃদু হেসে বলে,
“ তোমরা যাও। আমার একটু কলে কথা বলতে হবে। “
তরী একহাতে পার্থর ফোন টেনে নিয়ে বলে,
“ ফ্যামিলি টাইমের মাঝে নিজের ফোনকে একটু বিরতি দাও তো। “
শোভন ভাবীর সাথে সুর মিলিয়ে বলে,
“ চল না। তোর ফোন আর ফোনকল কোথাও পালিয়ে যাবে না। কিন্তু দুই দিনের জীবনে এই সুযোগ দ্বিতীয় বার না-ও আসতে পারে। “
শোভনের কথা শুনে তিনজনই তার দিকে সরু চোখে তাকায়। তিনজনের দৃষ্টি দেখে শোভন অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সে গলা ঝেড়ে বলে,
“ আমি তো কথার কথা বললাম। “
পার্থ আলতো হাতে নিজের ঘাড়ের একপাশ ম্যাসাজ করতে করতে বলে উঠে,
“ ওকে। নো ফোনকল। অনলি ফ্যামিলি টাইম নাও। “
__________
মুষুলধারে বৃষ্টির শব্দ নিস্তব্ধ রাতের সৌন্দর্য কয়েক গুণ বাড়িয়ে তুলেছে। সেই সুন্দর রাতে আরেকটা সুন্দর দৃশ্য হলো একজন যুবক বসে খুব মনযোগ দিয়ে নিজের স্ত্রীর হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে। সেই রমণীর সেদিকে খেয়াল নেই। সে আপনমনে চরম বিরক্তি নিয়ে বলে চলেছে,
“ লোকে আপনাকে দুইদিনের মধ্যে বউ পাগল উপাধি দিবে তূর্য। ভাববে আমি আপনাকে জাদু টোনা করে বিয়ে করেছি। “
তূর্য সামান্য গম্ভীর স্বরে বলে,
“ তোমাকে কে বলেছিলো রান্নাঘরে গিয়ে মাতাব্বরি করতে? আয়না খালা তো আছেই। “
পৃথা অবাক গলায় বলে,
“ তো? উনি আছে দেখে কি আমি যেতে পারবো না নাকি? কালকে ঈদ অথচ ঘরের বউয়ের রান্না করা কোনো খাবার না খেয়ে তুমি আর পাপা কালকে নামাজ পড়তে যাবে এটা কেমন দেখায়? “
“ আর এখন যে রান্নায় হাত লাগাতে গিয়ে মাছ মাংসের গন্ধে বমি করেছো এটা খুব ভালো হয়েছে তাইনা? “
পৃথা মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে ফিরে তাকায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তূর্য তার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,
“ হয়ে গিয়েছে। “
পৃথা আগ্রহ নিয়ে নিজের হাতের তালুর দিকে তাকাতেই দেখে একপাশে একটা চাঁদ আর তার পাশেই মেহেদী দিয়ে ইংরেজি লেটারে টি পি টি লেখা। পৃথা চোখ সরু করে প্রশ্ন করে,
“ একটা টি ফর তূর্য এবং পি ফর পৃথা নাহয় বুঝলাম। আরেকটা টি কার জন্য? “
তূর্য এবার বেশ আগ্রহী গলায় বলে,
“ আমাদের বেবির নাম। “
“ আপনি ঠিক করে ফেলেছেন? “
“ ফাইনাল ডিসিশন তোমার। তোমার পছন্দ হলে রাখবো। “
কথাটা বলেই তূর্য ফের আগ্রহী গলায় বলে,
“ আমার মনে হয় ইট ইজ এ বেবি গার্ল। “
“ আপনি কিভাবে বুঝলেন? “
“ শি ইজ এটাচড টু মি। মেয়ে বেবিরা না বাবাদের সাথে খুব এটাচড হয়? “
পৃথা ভাবুক গলায় বলে,
“ ইউ আর রাইট। এখন থেকেই কি জেদ রে বাবা! আপনি কিছুদিনের জন্য দূরে গিয়েছেন ও একদম খাবার দাবারের বিরুদ্ধে অনশণ জারি করে বসেছে। “
তূর্য নিঃশব্দে হাসে। পৃথা ফের আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে,
“ নাম কি ভেবেছেন বলুন না। “
“ তারিণী। “
পৃথা খুশিতে আটখানা হয়ে পড়ে। নামটা কি সুন্দর! তার বেশ পছন্দ হয়েছে। সে তূর্যর দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে আওড়ায়,
“ তারিণীর পাপা। “
‘ তারিণীর পাপা ‘ কথাটা শুনতেই তূর্যের বুকের ভেতর প্রগাঢ় আবেগের সমারোহ ঘটে। সেই আবেগকে পশ্রয় দিয়েই ও পৃথার পেটের কাছে মাথা নিয়ে সেখানে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“ মা? আমাকে শুনতে পাচ্ছো? তাড়াতাড়ি এসে পড়ো। পাপা ইজ ওয়েটিং ফর ইউ। লাভ ইউ। “
পৃথা হাসিমুখে বসে দেখতে থাকে সেই দৃশ্য। একটা ছোট্ট মেয়ে বাচ্চা কোলে তূর্যকে কেমন লাগবে ভাবতেই আবেগের আন্দোলনে কেঁপে উঠে সে।
__________
ঈদের দিন বিকেলে পরিবারের সাথে দেখা করতে চৌধুরী নিবাসে এসেছে পৃথা। সাথে তূর্য আর হুমায়ুন রশীদও রয়েছে। সবার সাথে কুশল বিনিময় করে শোভনের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরতেই শোভন ঠাট্টা করে বলে,
“ এই ভূতনি। তোর এই অবস্থা কেন? আমার ভাগিনা কিংবা ভাগ্নিকেও কি নিজের মতো পাতলু বানাতে চাস নাকি? “
পৃথা ঠোঁট উল্টে বলে,
“ আমি এখন এক বাচ্চার মা। প্রমোশন হয়েছে। সম্মান দিয়ে কথা বল আমাকে। আমার সাথে ফাইজলামি করলে বেবির কাছেও ঘেঁষতে দিবো না তোকে। “
“ তোর পারমিশনের অপেক্ষা কে করবে? “
পার্থ পাশ থেকে বলে উঠে,
“ তোর দিন শেষ পৃথা। এখন আমাদের সব আদর লুটে নেওয়ার জন্য জুনিয়র আছে। দুই মামা মিলে ওকে আদরে একদম বাঁদড় বানিয়ে ছাড়বো। তখন টের পাবি ছোটবেলায় তুই কেমন বাঁদড় ছিলি। “
পৃথা ভয়ে আঁতকে উঠে। তার বাচ্চা তার মতো দস্যি হলে সে পাগলই হয়ে যাবে। তার থেকে ভালো যদি তূর্যর মতো ঠান্ডা চুপচাপ হয়। তার ভয়ার্ত মুখ দেখে পার্থ আর শোভন চোখাচোখি করে একসাথে হেসে উঠে। দুইপাশ থেকে দুজন বোনের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলে,
“ বেক্কল! মজা নিচ্ছিলাম। “
ভাইদের আস্কারা পেতেই পৃথা আহ্লাদে ভেসে যায়। মুখ ফুলিয়ে বলে,
“ ছোট দা, তোর আইনের কোনো ধারা তে এই নীতি লেখা নেই যে একটা প্রেগন্যান্ট মহিলাকে রাগানো দণ্ডনীয় অপরাধ? “
পৃথার অযৌক্তিক বোকা কথা শুনে পার্থ ও শোভন আরেকদফা হাসে। দূর হতে মধুমিতা এই দৃশ্য দেখে বলে,
“ ইশ! আমারও যদি ভাইবোন থাকতো! “
তরী আর তূর্য মধুমিতার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। কথাটা তাদের কর্ণগোচর হয় না। তরী হেসে মধুমিতাকে টেনে একহাতে জড়িয়ে ধরে অপরহাতে তূর্যর হাত জড়িয়ে ধরে বলে,
“ আমরা আছি না? “
মধুমিতার মুখে হাসি ফুটে উঠে। সে আবার চোখ তুলে তূর্যর দিকে তাকায়। তূর্য হেসে বলে,
“ দুই বোন থাকলে কিন্তু মন্দ হয় না। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো | পর্ব - ৪৫ | ভালোবাসার গল্প | উপন্যাস এই পোস্ট টি পড়ার জন্য। আপনাদের পছন্দের সব কিছু পেতে আমাদের সাথেই থাকবেন।
