আমাদের চ্যানেলে ঘুরে আসবেন SUBSCRIBE

আদুরি পাখি ওয়েবসাইটে আপনাকে স্বাগতম™

সম্মানিত ভিজিটর আসসালামুয়ালাইকুম : আমাদের এই ওয়েবসাইটে ভালোবাসার গল্প, কবিতা, মনের অব্যক্ত কথা সহ শিক্ষনীয় গল্প ইসলামিক গল্প সহ PDF বই পাবেন ইত্যাদি ।

  সর্বশেষ আপডেট দেখুন →

ভালোবাসার গল্প | অবরুদ্ধ নিশীথ | পর্ব - ০১

Please wait 0 seconds...
Scroll Down and click on Go to Link for destination
Congrats! Link is Generated

 ১.


রাস্তা পার হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তূর তেজ ঠিক বিকেলের রোদের মতোই ক্ষীণ। আব্বু তার হাতটা চেপে না ধরলে চলে না। আব্বু রোজ থাকে না সঙ্গে। আজও নেই। এক পথিক চাচার পেছনে রাস্তাটা পার হয়ে দ্রুত রিক্সা ধরল।


শীতের রোদ, তবু খাড়া দুপুরে তাপ কড়া। বোরকা-হিজাবের আবরণের নিচে ঘামের স্রোত বেয়ে যাচ্ছিল তার।


ভার্সিটিতে ছাত্র পরিষদের কী এক প্রোগ্রাম ছিল। সেসবে অন্তূর ভালো রকমের বিদ্বেষ আছে। কারণ হিসেবে বলা যায়–তাকে শেখানো হয়েছে এবং বাকিটা নিজস্ব। 


অন্তূর ধারণা, ছাত্রলীগ—যাদেরকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অগ্রদূতের নাম দেয়া হয়েছে, তারা মূলত পঙ্গপাল। দলবদ্ধ হয়ে চলা ঘাসফড়িংয়ের জাতকে পঙ্গপাল বলে। দশ-পনেরো লক্ষ একত্রে চলাচল করে। এবং কোনো বিঘাখানেক জমির ফসলি ক্ষেতকে আক্রমণ করলে খুব অল্প সময়ে ক্ষেতের ফসল খুব ভালোমতো পরিষ্কার। এক শ্রেণির লোক অবশ্য এই ক্ষেত পরিষ্কারকে বরবাদ করাও বলবে। তাদের কথা কানে নেয়া উচিত না। ক্ষেতের ফসল উদ্ভিদের জন্য ভারী। উদ্ভিদকে সস্তি দিতেই হয়ত পঙ্গপাল সব ফসল ভক্ষণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে।


অন্তূর ধারণা, বাংলাদেশের ছাত্রলীগ নামক পঙ্গপাল দেশটা অর্থাৎ বাংলার আবাদী ক্ষেতের জন্য তেমনই এক দল পঙ্গপালের সমান।


আম্মার কল এসেছে কয়েকবার। তাঁর ভাষায়, খুব জরুরী কাজ। অন্তূ জানে, কোনো জরুরী কাজ-টাজ কিচ্ছু না। কিন্তু ছাত্রনেতাদের মুখ-পেটানো মহাবাণী থেকে মুক্তির একটা ছুঁতো দেয়ায় সে মায়ের প্রতি অল্প কৃতজ্ঞ।


দুপুরের ঝাঁজালো রোদে বাড়ি ফিরে যে জরুরী কাজটা দেখল অন্তূ, তাতে তার মাথাও দুপুরের রোদের মতোই উষ্ণ হলো। তাকে দেখতে আসা হয়েছে। প্রায়ই হয় এমন। 


মেহমানদের তাকে দেখার ধরণ সেই জাহিলি যুগের মেয়ে নামক পণ্য কেনা-বেচার মতো। এটা অন্তূর নিজস্ব মত। সে বিষয়টাকে পছন্দ করে না। তারা অন্তূর চুল খুলে ফেলল, একটানে শরীরে জড়ানো ওড়নাটা সরিয়ে গলা, বুক, হাত দেখা হলো। না, মেয়ে ফর্সাই আছে। অন্তূ চোয়ালের পাটি শক্ত করে চুপ করে থাকল। কিন্তু যখন সালোয়ার উঁচিয়ে তুলতে গেল মহিলারা ঠ্যাং দেখবার উদ্দেশ্যে, অন্তূর সীমিত ধৈর্য্যের বাঁধ খসলো। সালোয়ার ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল, তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে স্পষ্ট স্বরে বলল,


-“আপনারা মেয়ে দেখতে এসেছেন নাকি হাঁটে গরু কিনতে এসেছেন?ʼʼ 


পাত্রর মা হতভম্ব হলেন, অসন্তুষ্ট মুখে বলে উঠলেন, “ওমা! এ আবার কেমন কথা? মেয়ে দেখতে এসে মেয়ের পা দেখতে চাওয়া কি অপরাধ নাকি?ʼʼ


-“জি না! ঠিক অপরাধ নয়, মূর্খতা। কারণ আমি কোরবাণীর হাঁটে তোলা কোনো প্রজাতির গবাদী পশু নই, যে সবচেয়ে নিখুঁত, আকর্ষণীয় গায়ের রঙওয়ালা, মাংস বেশী, হৃষ্টপুষ্ট দেখে কিনে নিয়ে যাবেন।ʼʼ


স্পষ্ট, ঝরঝরে শুদ্ধ ভাষা অন্তূর মুখে, কিন্তু ভাষা কর্কশ। পাত্রর ফুপু মুখ কেমন করলেন, “কোনদেশি কথা যে, মেয়েকে ভালোভাবে দেখা যাবে না? নাকি কোনো দোষ আছে? তাছাড়া কোনো মেয়ে আছে, যে পাত্রপক্ষের মুখের ওপর এরকম বদমায়েশের মতো কথা বলে? আশ্চর্য মেয়ে তো দেখছি! দেখতে আসছি, তো দেখব না?ʼʼ


-“জি, নিশ্চয়ই দেখবেন। দোষ থাকা চলবে না, দরকার পড়লে মেয়ের দেহের প্রতিটা কোষ পর্যবেক্ষণ করা মেশিন এনে দেখবেন। পরনের সালোয়ার ঠ্যাঙে তুলে তারপর মেয়ের ঠ্যাঙ দেখবেন ফর্সা কি-না? রাইট!ʼʼ


উনারা মুখ বিকৃত করে বসে আছেন। অন্তূ আলতো হাসল, “দুঃখিত, চাচিমা। এটাকে আপনারা মেয়ে দেখা বললেও, আমি ছোটোলোকি বলছি। মেয়ে দেখতে এসে গাল ফেড়ে মেয়ের দাঁত দেখতে হবে, দাঁত উঁচু-নিচু আছে কিনা! মাথার চুল টেনেটুনে দেখতে হবে, চুল আসল না নকল, আছে না নেই, বড়ো না ছোটো? গলা বের করে, ঘাঁড়ের ওড়না খুলে, হাঁটিয়ে, নাচিয়ে এরপর পছন্দ হলে নিয়ে যাবেন! এটাই মেয়ে দেখা? অথচ বলুন তো, আমি যা যা বললাম, তা শুনতে এমন লাগল না, যে কোনো গৃহপালিত পশুর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। খরিদ্দার এসেছে গোয়াল থেকে পশু খুলে নিয়ে যেতে!ʼʼ


অপমান, অসন্তুষ্টি এবং বিরক্তি লেগে আছে মুখে তিনজনের। ছেলের ফুপু মুখ খুললেন “তো কীভাবে মেয়ে দেখে? তুমিই শেখাও কীভাবে মেয়ে দেখে?ʼʼ কথাটা বলে মুখ ঝামটি মারলেন মহিলা।


রাবেয়া অন্তূর দিকে চোখ গরম করে তাকাচ্ছেন। ঘরে পাড়ার মহিলাও আছেন কয়েকজন, পাশেই ঘটক মহিলা বসা। তিনি বললেন, “এ কেমনে কতা কও, মেয়ে! দেখতে আইলে একটু ভালো কইরেই দেখে মেয়ে। না দেখে শুনে আবার নিয়ে যায় নাকি? বাড়ির বউ হইবা বলে কথা!ʼʼ


অন্তূর কাছে এ কথার জবাব আছে—দেখেশুনে নিয়ে যাওয়াটা দোষের নয়। তবে দেখার মধ্যে মার্জিত এবং শালীনতার ব্যাপার তো আছে? মহিলাগুলো রীতিমতো তাকে অসম্মানমূলক ভাবে মেয়ে দেখার নামে এক প্রকার অপমান করছেন। একটা মেয়ের পাত্রপক্ষের সম্মুখে মেয়ের আত্মমর্যাদা-মূল্য শব্দের অস্তিত্ব নেই। শুধুই একটি জড় সামগ্রী, যাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, বাজিয়ে, দরদাম করে, পছন্দ হলে দয়া করে কিনে নিয়ে যাওয়া হবে। 


এই কথাগুলো চেপে গিয়ে ঘটক মহিলাটির কথার জবাবে চমৎকার হাসল, “বাড়ির বউ হব? কে বলেছে, আমি বলেছি? আমি এখনও অন্যের মেয়ে। আর অন্যের মেয়েকে বাজারের পণ্যের মতো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখা, দরদামের কথায় আসা যদি বিয়ের উদ্দেশ্যে মেয়ে দেখা হয়, তাহলে বিয়ে বোধহয় আমার জন্য না। আর আমার ধারণা আপনারদের আমাকে দেখেশুনে পছন্দ হলে যৌতুকের কথাও তুলবেন। এক্ষেত্রেও দুঃখিত, চাচি। আব্বু আমাকে খাইয়ে-পরিয়ে, আদর-যত্ন করে, এতগুলো বছর সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন যৌতুকের বদলে বিয়ে দিয়ে আমার বোঝা নামাতে নয়। তাছাড়া আমিও ইচ্ছুক নই, আমার জন্য পয়সা দিয়ে কোনো খেলনা পুরুষ কিনতে।ʼʼ


পাত্রর মা অন্তূর মায়ের দিকে তাকিয়ে এবার কড়া স্বরে, তাচ্ছিল্যে করে মুখ বিকৃত করলেন, “আপা! সে আপনি মেয়েকে যতই শিক্ষিত করেন, আদর্শ শিখাইতে পারেন নাই। এরকম মেয়ে কার ঘরে যাবে, আল্লাহ মাবুদ জানে। আপনার কপালে কী আছে এই মেয়ে নিয়ে, আল্লাহ-ই জানে! অন্তত কোনো ভদ্র পরিবারে তো যাবে না।ʼʼ


অন্তূ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “আত্নসম্মানহীনতা যদি আদর্শ হয়, আমি বরাবর অভদ্র এবং জঘন্য আদর্শে পালিত এক মেয়ে। ক্ষমা করবেন এই বেয়াদবকে।ʼʼ


অন্তূ আর বসল না। সকলের বিভিন্নরকম দৃষ্টিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল নিজের রুমের দিকে। 


তার নামে সমাজে রটা কথা নেহাত কম না। প্রতিনিয়তই লোকে তাকে আলোচনায় রেখেছে–অন্তূকে তার মা-বাপ মিনসের মতো মানুষ করছে। নষ্টা মেয়ে, ভ্রষ্টা মেয়ে, বেয়াদব, অসভ্য, আদর্শহীন, ভার্সিটিতে পরিয়ে মিনিস্টার বানাতে চায় মেয়েকে… পাড়ার লোকের দেয়া টাইটেলের অভাবের পড়েনা অন্তূর ভাগে। 


কিছুক্ষণ পর সকলকে বিদায় করে রুমে এলেন রাবেয়া বেগম। তিনি কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই অন্তূ বলল, “এরকম লোকদের সামনে বসানোর জন্য তুমি আমায় টিউশনি কামাই করিয়ে বাড়ি ডেকে আনলে? তোমার আক্কেলকে আর কতটা সাধুবাদ জানাব আমি, আম্মা!ʼʼ


রাবেয়া বেগম অসন্তুষ্ট স্বরে বললেন, “একটা থাপ্পড় মারব, বেয়াদব মেয়ে! দিনদিন বেলেহাজ হয়ে যাইতেছ তুমি? বেশি লাই দিয়ে ফেলতেছি নাকি আমি? আর কয়টা পাত্রর সামনে আমার মান-ইজ্জত নষ্ট করবি তুই? মা হিসেবে তোকে পার করতে চাওয়ার কোনো হক নাই আমার? পাড়ার লোকে একের পর কথা কথা বলতে ছাড়তেছে না প্রতিদিন। সে-সবই তো শুনতেছি। তুই পরিস্থিতি বুঝবি কোনোদিন? বেকায়দা মেয়েলোক জন্মেছে আমার পেটে!ʼʼ


অন্তূ দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে হাসল, “আম্মা, তোমার তো সবসময় আমার উপর অভিযোগ থাকে। ধরে নিয়ে আসো এসব মূর্খ, ছোটো মানসিকতার লোকদের! তোমার কী ধারণা, যার তার গলায় ঝুলে পড়ব আমি? আব্বু তো বলেনা বিয়ের কথা, তুমি কেন কান দাও মানুষের কথায়? আব্বু এজন্যই বলে, তোমার বিবেকে ইমপ্রুভমেন্ট দরকার।ʼʼ


-“তোর বিবেক কাজে লাগা। তা লাগালেই তো মিটে যেত সব। এই দিয়ে কতগুলার সাথে এমন হইলো? পাড়ার লোকে খুব ভালো কয় এতে, তাই না? ভার্সিটিতে পড়াচ্ছি তা নিয়ে কত কথা শুনলাম, এখন বিয়ে করাচ্ছি না তা নিয়ে লোকে কানাঘুষা শুরু করছে, এই যে এসব আচরণ করিস, লোকের কানে যায় না? তোর বাপ তো শিক্ষিত অন্ধ। তার আর কী?ʼʼ


টেবিলের ওপর বইখাতা ছিটিয়ে আছে। সেগুলো গোছাতে গোছাতে অন্তূ বলল, “আম্মু! তুমি দু'দিন না খেয়ে থাকো, কেউ তা নিয়ে আলোচনা করবেনা, আর না এক মুঠো ভাত দিয়ে তোমায় সান্ত্বণা দিতে আসবে। কিন্তু যখন তুমি নিজের মতো করে  কিছু করতে চাইবে, সেটা তাদের আলোচনার খোরাক জোগাবে। তাহলে যেই মানুষেরা তোমার কষ্টকে আলোচনা করে সুখের রূপ দিতে পারেনা, তাদেরকে তোমার ভালো থাকাকে কেন খারাপ থাকাতে বদলাতে সুযোগ দেবে?ʼʼ


শেষের দিকে কঠিন হলো অন্তূর কণ্ঠস্বর।  রাবেয়া বেগম বললেন, “তুই এতো অবুঝ ক্যান, অন্তূ? মেয়ে মানুষের এতো মুখরা হতে নেই। সমাজে কথা হয়। বোবার কোনো বিপদ থাকেনা। চুপ থাকলে নাজাত রে আম্মা।


সোজা হয়ে দাঁড়ায় অন্তূ, চোখে-মুখে দ্যুতিময় দৃঢ়তা ফুটে ওঠে, “আমার নাজাত চাই আখিরাতে। বেঁচে থাকতে কীসের নাজাত, আম্মা? যেখানে জীবনটাই টানপোড়েনের এক সমষ্টি মাত্র!ʼʼ


রাবেয়া আস্তে করে এসে মেয়ের পাশে বসে বললেন, “এখন বিয়ে যদি নাও যদি করিস, পরে করবি তো! তখন যখন লোকে তোর ব্যাপারে শুনতে আসবে আশেপাশে, কী বলবে লোকে? মেয়েলোকের ঠান্ডা মেজাজের, নরম হইতে হয়। এতো কথা, এতো যুক্তি, এতো প্রতিবাদ! তুই বুঝিস না, এইসব বিপদ আনে খালি। এইসব কি পড়ালেখা থেকে আসতেছে? আমি কি এতদূর তোরে পড়ালেখা করায়ে ভুল করছি?ʼʼ


কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুচকি হেসে শান্ত-স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, 

“আমাকে অন্তূ থেকে– অ্যাডভোকেট মাহেজাবিণ আরমিণ অন্তূ হতে এমন বহু চড়াই-উৎড়াই পেরোতে হতে পারে। একজন আইনজীবীর জীবন মুখবন্ধ আর নির্ঝঞ্ঝাট চলতে পারেনা, আম্মা!ʼʼ


সারারাত পড়ার পর সকালের দিকে ঘুমানো হয় রোজ।সেদিন ক্লাসটেস্ট পরীক্ষা ছিল। মাসখানেকের ছুটির পর ক্লাস শুরু ভার্সিটিতে। আজকাল ঘনঘন ছুটি চলে। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। চারদিক উত্তাল।


ফজরের নামাজও কামাই হয়ে গেছে। উঠে গিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিলো, “কিছু খাওয়ার আছে নাকি, আম্মু?ʼʼ


তরকারী চুলায় বসাতে বসাতে বললেন রাবেয়া, “কী থাকবে? আব্বুর কাছে যা, দেখ বারান্দায় মুড়ি-চানাচুর দিছি।ʼʼ


আমজাদ সাহেব খবরের কাগজে ঢুকে গেছেন। অন্তূ পাশে বসল, “কী দেখছো?ʼʼ


আমজাদ সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, “সেই গ্রেফতার, বাসে আগুন, হরতাল....ʼʼ ওর দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে  বললেন, “নে। এত রাত জাগতে বলে কে? বলি, সন্ধ্যায় পড়তে বসবি। চোখ-মুখের কী হাল হয়েছে? আজ থেকে আমি বসব পড়ার টেবিলে।ʼʼ


অন্তূ অল্প মুখ ফুলিয়ে বলল, “আমি এখনও বাচ্চা নেই,  আব্বু।ʼʼ


আমজাদ সাহেব ভরাট গলায় বললেন, “টোস্ট নে। গলা দিয়ে খাবার নামতে চায়না? চা-টুকু শেষ কর।ʼʼ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আনমনে মুচকি হাসলেন আমজাদ সাহেব, “মা বলতো, 'ও আমজাদ যার শইরে মাংস লাগেনা, তার মাতায় পড়ালেহা ছাই ঢুকবো? আয় তো পাকা আম আনছে তোর আব্বা। দুধ-ভাত মাখাইছি, আয়। পরে পড়বি।ʼʼ


দাদিকে অন্তূ দেখেনি। আব্বুর দিকে অনিমেষ চেয়ে থাকল। গম্ভীর এই মানুষটা যখন কদাচিৎ সল্প হাসেন, সৌম্য পৌঢ়া চেহারায় যে জ্যোতি ফুটে ওঠে, আর ওই মেহেদি দেয়া দাড়ির নিচে চকচকে সাদা দাঁতের মসৃণ হাসি, অন্তূর বুকে কাঁপন ধরে যায়। এই মানুষটাকে ছাড়া সে সর্বনিঃস্ব!


-“আমাকে আজ নামিয়ে দিয়ে যাবে একটু ভার্সিটিতে?ʼʼ


আমজাদ সাহেব টান করে ধরে খবরের কাগজের পৃষ্ঠা উল্টালেন, “তোর ভার্সিটি সেই দশটায়, আমি সাড়ে আটটার ট্রেন ধরব, এখনই বের হব। রিক্সা ঠিক করে দিয়ে যাব। খেয়ে যাবি।ʼʼ


অন্তূ ঠোঁটে ঠোঁট গুজল, “দরকার নেই রিক্সার। শোনো, তুমি গোসল করে যাবে। রোদ ভালোই বাইরে। প্রেশার বাড়বে নয়ত।ʼʼ


আমজাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “ভার্সিটি থেকে নাকি হলে থাকার কথা বলেছে?ʼʼ


-“আম্মা কি আর রাজী হবে তাতে?ʼʼ


আমজাদ সাহেব গম্ভীর চোখে তাকিয়ে অন্তূর কপাল ছুঁলেন। কিছু লেগে ছিল, তা সযত্নে মুছে ভারী গলায় বললেন, “সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল কবে?ʼʼ


-“ক্লাস টেস্ট চলছে, খুব তাড়াতাড়ি ডেইট পড়বে মনে হয়।ʼʼ


খবরের কাগজটা অন্তূর হাতে দিয়ে উঠে পড়লেন আমজাদ সাহেব। অন্তূ পিছু ডাকে, “আব্বু!ʼʼ


পিছে মুড়লেন তিনি, “হু!ʼʼ


অসহায় দেখায় অন্তূর মুখটা, “কবে ফিরবে তুমি?ʼʼ


-“দু'দিন দেরি হবে হয়ত। কাজ না থাকলে ফিরে আসবি ক্লাস শেষে। কোথাও দেরি করবি না।ʼʼ


অন্তূ আস্তে কোরে মাথা নাড়ে, “হু।ʼʼ


সামনে ফিরে সামান্য হাসলেন। অন্তূ থাকতে পারেনা উনাকে ছাড়া, তার তেজস্বী মেয়ে এই এক জায়গায় কাবু। অথচ পাগলি বোঝেনা, চিরকাল এই আব্বুটা সাথে থাকবে না। সামনের পথ তাকে একা পাড়ি দিতে হবে।


ভার্সিটির সামনে এসে রিক্সা থামল। ক'দিন আগেই তুমুল আন্দোলন হয়ে গেছে ছাত্রপরিষদের। দেশটা ভালো চলছে। রোজ খু"ন-গুম-কারাবরণ অবিরাম। থামাথামি নেই, সরকারের ক্লান্তিও নেই। খুব পরিশ্রম করছে দেশটাকে নিজের মতো চালাতে। মানুষজন একটু দুশ্চিন্তায় আছে অবশ্য, তবে সরকার ভালো আছে। সে তার মনমতো দেশ চালাচ্ছে। কেউ ভয়ে বিরোধিতা করে না। করলে কারাগার নেহাত কম নয় দেশে। অস্ত্র এবং দেশপ্রেমিক সৈনিকের সংখ্যাও বেশ।


ফটকের ওপর বড় বড় অক্ষরে লেখা— হাজি মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। দিনাজপুরের বাঁশেরহাট থেকে খুব বেশি দূরে নয় অন্তূদের বাড়ি। হলে থাকার প্রয়োজন পড়ে না বিশেষ।


শহীদ মিনার চত্বরের আশপাশটা বেশ ভালো লাগে অন্তূর। জায়গাটা পার করার সময় পেছন থেকে ডাকল কেউ। অন্তূর পিছু ফিরে দেখল, ছয়জন যুবক। তার সিনিয়র হবে নিশ্চিত। সামনে যে দাঁড়িয়ে, তাকে চেনা চেনা লাগল। আগে দেখা মুখ, তবে মনে নেই বিশেষ কিছু।  


সে এগিয়ে এসে হাতের সিগারেটটা অন্তূর দিকে বাড়িয়ে বলল, “নাও, একটা টান দাও!ʼʼ


অন্তূ নিঃসংকোচ হাতে নিলো সিগারেটটা। তার একটা দোষ আছে। সে ভেতর আর বাহির আলাদা করতে পারে না। যেমন মনে ঘৃণা রেখে মুখে হাসা যায়। কিন্তু তার সেই দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা নেই। সিনিয়রদের প্রতি তার বিদ্বেষ পুরোনো। তা সেদিন বেরিয়ে এসছিল ভুলক্রমে।


অন্তূ আধখাওয়া সিগারেটটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলেছিল, “টান না-হয় দেব একটা, কিন্তু এতে ফযিলতটা কী?ʼʼ


পাখির মতো চঞ্চল দৃষ্টি লোকটার। অন্তূর চোখে চোখ গেঁথে হেসে উঠল সে, “ফযিলত? এই যে আমি তোমারে টান দিতে বলতেছি, এর চাইতে বড়ো ফযিলত বা হাকিকত কিছু নাই, সিস্টার! আর জরুরী তো মোটেই না যে সবকিছুতে ফযিলত থাকা লাগবে! এক টান মারো। স্বাদ ভালো। ব্যান্সন এন্ড হেজেস।ʼʼ


অন্তূ যথাসম্ভব শান্ত কণ্ঠে বলল, “কিন্তু আপনি টান দিতে বললেই দিতে হবে, তা কেন? এটা আশিভাগ মুসলিমের দেশ, বাংলাদেশ। সেক্ষেত্রে আমিও পশ্চিমা সংস্কৃতির মেয়ে না। সিগারেটে অভ্যস্ত নই আমি।ʼʼ


সে কপালটা সামান্য জড়িয়ে হাসল। হাসার সময় তার গা দুলে ওঠে, ভঙ্গিমাতে বড় বেপরোয়াপনা। সে বলল, “তবু এক টান মারো দয়ালের নামে।ʼʼ


অন্তূ দু-একবার আশপাশে তাকাল বোকার মতোন। কেউ আসার নেই বোধহয় তাকে বাঁচাতে। এর অবশ্য কারণ আছে। মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে সে কোনো বিপদে পড়েনি। কিন্তু তারা এসে অন্তূর পক্ষে এবং সামনের জনের বিপক্ষে কথা বললে যা হবে সেটা বিপদ। 


হিজাবের আড়ালে অন্তূর শরীরটা দু-একবার ঝাঁকুনি খেলো। তবু পরিষ্কার গলায় বলল, “তবু কেন?ʼʼ


পেছন থেকে কবীর ক্যাটক্যাট করে বলে উঠল, “কারণ আমরা সিনিয়র। এরপর আর কোনো ফযিলতের খোঁজ করলে তুমি নিখোঁজ হয়ে যাবা। ঠিক বলিনি ভাই?ʼʼ


পেছনের ছেলেরা হাসল। সে বলল, “আলবাৎ সহি কথা কইছিস।ʼʼ


সকলে দেখছে ওদের। অন্তূ মাথা নাড়ল, “উমমম! সাংঘাতিক ব্যাপার দেখছি! তবে সিনিয়রের মতো আচরণ আপনাদের একজনেরও নয়।ʼʼ


সে ভ্রু নাচিয়ে বাহবা দিয়ে এগিয়ে অন্তূর মুখের ওপর ঝুঁকে এলো, “তুমি তা জানাবা, ডিয়ার?ʼʼ


অন্তূ ঘৃণায় মুখটা পিছিয়ে নেয়। ভোক ভোক করে গন্ধ আসছে তার মুখ থেকে। অন্তূ নিজ গরিমায় বলে ওঠে মাড়ি শক্ত করে, “জানাতেই পারি। শিক্ষার বয়স হয় না। বলা হয়, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করো।ʼʼ


কবীর কিন্তু সহৃদয় ব্যক্তি। সে সাবধান করল, “হুঁশিয়ারী করছ? সিনিয়রদের সামনে মুখ চালাচ্ছ? মারা পড়বে, মেয়ে! কবে ভর্তি হয়েছ, কে বড়ো কে ছোটো বিষয়টা বুঝে উঠতে পারোনি মনে হচ্ছে?ʼʼ 


কবীরের খুব হাসি পাচ্ছে ছোট্ট মেয়েটার দুঃসাহসের ওপর। বড় ইচ্ছে করছে নেকাবটা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। ফেলাও তো উচিত। মেয়েটা বেয়াদব।


অন্তূ হাসল, “কুকুর ছোটো হোক অথবা বড়ো, তাকে কুকুর বলার সৎসাহসটুকু থাকা অবশ্যই ভালো গুণ! কী বলেন সিনিয়র মশাই!ʼʼ কথাটা অন্তূ, ঘাঁড় বাঁকা করে তাকিয়ে থাকা সেই সিগারেটওয়ালা লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল। 


সে ভ্রু কিঞ্চিৎ জড়ায়, যা খুব সূক্ষ্ণ। তার খুব আনন্দ লাগছে। নতুন ধরণের অভিজ্ঞতা এটা। তাদের সামনে কেউ তো কথা বলে না। মেয়েটা নিশ্চিত তাকে চেনে না।


অন্তূ আবার বলল, “একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে, তাকে ডেকে সিগারেট টানতে বলা, পানির বোতল ভরানো, জুতো পরিস্কার করানো, আজেবাজে কথা চিরকুটে লিখে তা অন্যকে দেওয়ানো, হ্যারাস করা, হুমকি দেয়া, হলে ডেকে নেয়া–এসব আপনাদের কাছে সিনিয়রের সংজ্ঞা? অথচ আমি যে বই থেকে সিনিয়রের সংজ্ঞা পড়েছিলাম, সেখানে লেখা ছিল–সিনিয়র হলো শিক্ষক, যে জুনিয়রকে আদব শেখাবে, শিষ্টাচার বোঝাবে, একটা ভুল করলে ধমক দিয়ে ভুলটা শুধরে দেবে, কোনো প্রয়োজনে সাহায্য করবে ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছুই লেখা ছিল। সেই বই আপনাদের হাতে পড়েনি। দুঃখজনক। মূলত আপনারা রাজনৈতিক পাওয়ার শো করতে এসেছেন, ভুল বলিনি আমি নিশ্চয়ই!ʼʼ


সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে চেপে পিষে ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেল। ছেলেগুলো ধরতে যায় অন্তূকে। সে বাঁধ সাধল, “উহু! বয়েজ, কুল কুল! মালটা তো একদম আলাদা রে! সবার চাইতে আলাদা। তার সাথে খেলাটাও হবে একদওওম আলাদা! শালার রাজনীতিতে আসার পর কত্ত ভদ্ররনোক হয়ে গেছি আমি, ভাবা যায়? আমাকে চেনেনি মনেহয়। পাত্তাই দিলো না, ছেহ!ʼʼ 


আস্তে করে মুখটা তুলে আকাশের দিকে তাকাল, “কুকুর বলেই খালাস হয়ে গেলে, মেয়ে! পেটে যে কুকুরের ভীষণ খিদে, সেইটা খেয়াল করলে না! নট ফেয়ার, নোপ! দিস ইজ নট ফেয়ার!ʼʼ 


হুট করে আবার আসমান থেকে চোখ নামিয়ে ঘাঁড় নাড়ল দুদিকে, “চ্যাহ! উহহ কী তেজ! আমি ডিস্টার্বড রে!ʼʼ 


সিগারেটটা সে তুলল। সেটা কবীরকে দেখিয়ে বলল, “রেখে দে এটা যত্ন করে। পাখি শিকার করার পর একবার করে এটা দেখব, আর... তাই বলে আমার সাথে এভাবে? এ ও আমাকে চেনে? চেনে রে আমাকে?ʼʼ


সামনের দাঁতক পাটি ঘষল মৃদু। ঘাঁড়ে হাত বুলিয়ে আড়চোখে সামনে তাকিয়ে দেখল। আবার আকাশের পানে তাকাল, “সামনে ইলেকশন! নিজেকে বাঁচিয়ে চলছি, তাতে দেখতেছি ম্যালা লোকই রঙ্গ-তামাশা দেখায়ে চলে যাচ্ছে! এইটা কি ঠিক হচ্ছে, বল তো! ইলেকশন তো শেষ হবে তাই না? এরপর কী হবে, তা ভাবছে না কেন এরা?ʼʼ


উন্মাদের মতো হাসল সে। ভার্সিটি চত্বরে লোকজন কম এখন। ক্লাসের ফুল টাইম চলছে। লোক থাকলেও তার যায়-আসার কথা নয়। যে পাশ কাটাচ্ছে, সালাম ঠুকে যাচ্ছে তাকে। সে আবার তাকাল অন্তূর দিকে। অন্তূ ততক্ষণে ঢুকে পড়েছে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিল্ডিংয়ে।


চলবে…


#অবরুদ্ধ_নিশীথ

#তেজস্মিতা_মুর্তজা


[১. উপাখ্যানটিতে অকথ্য গালিগালাজ, আঞ্চলিকতা, নৃশংসতার বর্ণনা রয়েছে। সুতরাং যারা এ ব্যাপারগুলোতে অস্বস্তিবোধ করেন, তাদেরকে না পড়ার পরামর্শ রইল।এছাড়াও টুকটাক রাজনৈতিক বিষয়াদি রয়েছে, যা দ্বারা প্রভাবিত না হলেই ভালো।


২. উপাখ্যানে স্থান ও সময়কাল কিছু ক্ষেত্রে অ-কাল্পনিক থাকবে। কিন্তু তার সঙ্গে শতভাগ বর্ণনার ধারা মিলবে না, এবং সেটা ধারা গঠনের স্বার্থেই। এখানে যে বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা শুধুই বর্ণনার প্রয়োজনে। কোনো ভার্সিটি এবং বাস্তবতাকে অবমাননা বা ইন্ডিকেট করে নয়। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভালোবাসার গল্প | অবরুদ্ধ নিশীথ | পর্ব - ০১ এই পোস্ট টি পড়ার জন্য। আপনাদের পছন্দের সব কিছু পেতে আমাদের সাথেই থাকবেন।

إرسال تعليق

Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.
A+
A-
দুঃখিত লেখা কপি করার অনুমতি নাই😔, শুধুমাত্র শেয়ার করতে পারবেন 🥰 ধন্যবাদান্তে- আদুরি পাখি