#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
২.
পরদিন ক্লাস শেষে ভীষণ ক্লান্ত অন্তূ। ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর ডেকেছেন। ডাকার কারণ স্পষ্ট নয়। অন্তূকে পিয়ন থামালো দরজার সামনে, “দাড়ান আপনে। স্যার বিজি আছে। মিটিং চলতেছে ভিতরে।ʼʼ
ভেতর থেকে প্রফেসর ইউসুফ সিরাজীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “ভেতরে আসতে দাও ওকে।ʼʼ
অন্তূর একটু সন্দেহ হলো, কোনো গুরুতর বিষয় নয় তো! ভেতরে প্রবেশ করে সালাম জানাল। ইউসুফ সিরাজী মাথা নাড়লেন, “এসো!ʼʼ
আরও কয়েকজন বড়ো বড়ো শিক্ষক রয়েছেন কক্ষে, এবং টেবিলের সামনে ডানপাশে চেয়ারে বসে আছে এক লম্বামতো পুরুষ, পরনে পাঞ্জাবী, মুখে চাপদাড়ি। এলাকায় একনামে বড়ভাই। যার মুখভঙ্গি একদম স্বাভাবিক, নিচের দিকে তাকিয়ে আছে শীতল দৃষ্টি মেলে। একে অন্তূ চেনে, ভার্সিটির ছাত্র সংসদের মেজর মেম্বার— হামজা পাটোয়ারী। ইউসুফ সিরাজী জিজ্ঞেস করলেন, “গতকাল কী হয়েছিল?ʼʼ
অন্তূ ইতস্তত না করে বলল, “আমাকে র্যাগ দেয়া হয়েছিল, স্যার!ʼʼ
-“সে তো আর নতুন কিছু নয়। তুমি কী করেছ?ʼʼ কড়া শোনাল প্রফেসরের কণ্ঠস্বর।
অন্তূ দমল না, বলল, “আমাকে সিগারেটে টান...ʼʼ
-“আহ!ʼʼ ব্যাপারটা যেন শুনতে আগ্রহী নন স্যার, বিরক্ত হলেন, “তুমি কী করেছ সেটা বলো!ʼʼ
অন্তূ স্যারের সম্মানে বিনয়ের সঙ্গে তবে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমাকে ধূমপান করতে বলা হয়েছিল, স্যার। আর তাতে অভ্যস্ত নই আমি। তাই সিগারেটটা নিয়ে ফেলে পা দিয়ে নষ্ট করে দিয়েছি।ʼʼ
মুখভঙ্গি শক্ত হলো প্রফেসরের। চোখ পাকালেন তিনি, চাপা স্বরে ধমকে উঠলেন, “এই শিখেছ? কার সঙ্গে এই আচরণ করেছ কোনো জ্ঞান আছে সে বিষয়ে? অভদ্র মেয়ে! সিনিয়রদের সঙ্গে এই আচরণ শিখেছ এতদিনে? ভার্সিটিতে আসো বেয়াদবী শিখতে? আদবের বালাই নেই ভেতরে! তুমি জানো, এতে তোমার এডমিশন ক্যানসেল হতে পারে? নাম কী?ʼʼ
অন্তূ অবাক হলো, উল্টো তাকে ব্লেইম করা হচ্ছে! অবশ্য চমকানোর কিছু নেই। দুনিয়ার সংবিধানের নাম যেখানে অরাজকতা ও সুশাসনহীনতা! সেখানে এটা নেহাত স্বাভাবিক ব্যাপার! নাম বলল সে, “মাহেজাবিণ আরমিণ অন্তূ।ʼʼ
-“বাবার নাম?ʼʼ
একটু ভয় হলো অন্তূর, এসব আব্বুর কানে গেলে...আব্বু সম্মানী মানুষ, তামাশা নিতে পারবেন না। জবাব দিলো, “আমজাদ আলী প্রামাণিক।ʼʼ
-“স্কুল মাস্টার আমজাদ নাকি?ʼʼ
-“জি!ʼʼ
-“এখনও মাস্টারি করে?ʼʼ
-“জি না। রিটায়ার করেছেন বছরখানেকের মতো।ʼʼ
ইউসুফ সিরাজী হামজাকে জিজ্ঞেস করলেন, “হামজা! তুমি কিছু বলবে?ʼʼ
হামজার মুখভঙ্গি দুর্বোধ্য। বোঝার চেষ্টা করল অন্তূ, অথচ বিশেষ অভিব্যক্তি নেই মুখে। অন্তূর দিকে তাকালও না একবার চোখ তুলে, মৃদু একবার ঘাঁড় নেড়ে দাম্ভিকতার সাথে ডানহাতের তর্জনী আঙুল তুলে ইশারা করল অন্তূকে বের হয়ে যেতে। জলদ গম্ভীর প্রতিক্রিয়া তার। যেন নেহাত অনিচ্ছুক সে অন্তূর সাথে কোনোপ্রকার কথা বলতে।
কক্ষ থেকে বেরিয়ে অন্তূ থমকাল। সে কি কোনো অনিশ্চিত ঝামেলায় জড়িয়ে যাচ্ছে! একটা অজানা বিষণ্নতা টের পেল সে ভেতরে, যা যুক্তিহীন বলেও মনে হচ্ছে, আবার কিছু একটা খোঁচাচ্ছে ভেতরটায় খুব। হামজা পাটোয়ারী কেন বসেছিল ওখানে?
আজ প্রথমবার অন্তূ হামজাকে এতো কাছ থেকে দেখল। আগে দেখেছে বিভিন্ন পোস্টার এবং প্রোগ্রামের ব্যানারে, নয়ত ভার্সিটি প্রোগ্রামে বক্তব্য দেওয়া বা নেতৃত্ব প্রদানের সময়।
শহীদ মিনার চত্বর পেরিয়ে যাবার সময় মেয়েলি ডাক কানে এলো। মেয়েটা পরিচিত, নাম তানিয়া। ওর দুই ইয়ার সিনিয়র। এগিয়ে গিয়ে বলল, “জি, আপু!ʼʼ
-“গতদিন আবার কী হয়েছিল ভার্সিটিতে?ʼʼ
অন্তূ বসল সিড়ির ওপর, “গতদিন আবার? কেন, এর আগেও কি কিছু ঘটেছে নাকি ভার্সিটিতে?ʼʼ
তানিয়া জিজ্ঞেস করল, “কোন ইয়ার যেন তুমি?ʼʼ
-“সেকেন্ড ইয়ার।ʼʼ
-“ও আচ্ছা! ছুটিতে ছিলে তোমরা! ভার্সিটিতে হওয়ার কি আর কোনো কমতি আছে? একের পর এক হয়-ই। তোমার কী হয়েছে গতদিন, জয় আমিরের সঙ্গে?ʼʼ
অন্তূ কপাল জড়াল, “জয় আমির?ʼʼ
প্রশ্নটা খুব অপছন্দ হলো তানিয়ার, বিরক্ত হলো, “দুই বছর ভার্সিটিতে পড়ছো, এবার কি বলবে জয় আমিরকেও চেনো না নাকি? ভার্সিটির ছাত্রলীগের সম্পাদককে চেনো না? কাউন্সিলরের ছেলে হামজা পাটোয়ারীকে চেনো?ʼʼ
-“জি, চিনি।ʼʼ
-“আর জয় কে? হামজার ফুফাতো ভাই, জয় আমির।ʼʼ
-“ও আচ্ছা!ʼʼ একটু দ্বিধান্বিত দেখালো অন্তূকে।
তানিয়ার জয়ের হুলিয়া বর্ণনা করতে শুরু করল, “দুই বছর আগে এখান থেকে অনার্স শেষ করেছে। শ্যামলা বর্ণের লম্বা করে, থুতনির কাছে একটা তিল আছে। গলায় চেইন, তাতে J লেটার আছে। ডানহাতে ঘড়ি পরে আর বামহাতে ব্রেসলেট..ʼʼ
অন্তূর সেসব শুনতে ইচ্ছে করছিল না। বুঝল, যে তাকে সিগারেটে টান দিতে বলেছিল, সে-ই জয়! আর শুনতে চাইল না এই বিশদ বর্ণনা, দ্রুত মাথা নাড়ল, “জি, এবার চিনেছি।ʼʼ
-“কী করেছে ওরা তোমার সঙ্গে?ʼʼ এমনভাবে কথাটা বলল তানিয়া যেন কোনো বিশেষ গোপন রহস্যের ব্যাপারে খোঁজ করছে। অন্তূ বলল, “বিশেষ কিছু নয়, র্যাগ দিয়েছিল।ʼʼ
এবার তানিয়া আরও সতর্ক হয়ে উঠল, “আরে! লজ্জা পাচ্ছ কেন? আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না, এসব হতেই থাকে, বলো কী করেছে ওরা তোমার সঙ্গে?ʼʼ
অন্তূ অবাক হলো, “আশ্চর্য! লজ্জা পাওয়ার প্রশ্ন কেন উঠছে? বললাম তো, সাধারণ র্যাগ দিয়েছে। আর কীসব হয়ে থাকে?ʼʼ
তাচ্ছিল্য করে হেসে উঠল তানিয়াসহ পাশের মেয়েগুলো। তানিয়া মুখ বিকৃত করে বলল, “কেন? তুমি বোধহয় জানো না, র্যাগিংয়ে মেয়েদের সাথে কী কী করা হতে পারে?ʼʼ
-“জি, জানি। তবে আমার সঙ্গে তেমন কিছু হয়নি।ʼʼ
তানিয়া কেমন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায়, “তাই নাকি? যাক, তা যদি সত্যি হয়, তো ভালো। কিন্তু তুমি কী করেছ? তোমাদের নিয়ে কানাঘুষা চলছে ভার্সিটিতে। তোমার সাহস বেশি হয়েছে নাকি?ʼʼ
-“কানাঘুষা? কানাঘুষার মতো কিছু তো হয়নি! আর সাহসের কী আছে এতে! যা আমার পছন্দ নয়, তাতে আমি সাফ মানা করে দিয়েছি।ʼʼ
তানিয়া চোখ উল্টালো, “মেয়ে, তোমার তো মাথায় দোষ আছে মনে হচ্ছে! তুমি সিনিয়রের সাথে বেয়াদবি করে এসে বলছো কানাঘুষার কিছু হয়নি! হয় তুমি পাগল, নয়ত বোকা অথবা দুঃসাহসী বলা যায়! কিন্তু এখানে দুঃসাহস টেকার না। তুমি সিনিয়রদের সাথে এরকম অবাধ্যতা করলে কোন সাহসে! জয়কে তো দেখছি তাহলে আসলেই চেনোই না তুমি? ভার্সিটিতে কি ঘাস কাটতে আসো, খবর বা রুলস কিছুরই জ্ঞান রাখো না নাকি!ʼʼ
অন্তূর খুব বলতে ইচ্ছে করল, ঘাস কাটতে যদি নাও আসি, তবে এসব পঙ্গপালদের খবর রাখতে নিশ্চয়ই আসি না! আসি পড়ালেখার জন্য, তা শেষ করে ফিরে যাই।
চেপে গেল, শঙ্কিত হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যেই ভেতরটা। ভয়টুকু সে চাপল ভেতরে, “কীসের খবর রাখার কথা বলছেন?ʼʼ
মেয়েগুলো একে অপরের দিকে তাকাল, একটু তাচ্ছিল্যে হাসল সকলে। তানিয়া বলল, “এর আগে বহু মেয়ে ভার্সিটি ছেড়েছে জয়ের কারণে, তোমরা তখন এডমিশন নাওনি, তখন জয় সেকেন্ড ইয়ারে ছিল বোধহয়। একটা মেয়ে হলের ছাদ থেকে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল। ওরা কী করেছিল মেয়েটার সঙ্গে জানা নেই। কিন্তু একটা কথা পরিস্কার, জয় এক অভিশাপ! আবার ভালোও!ʼʼ
-“আবার ভালোও কেন?ʼʼ
-“রাজনীতির চাল বোঝো না? সমাজসেবার কাজবাজ করে দুই ভাই মিলে। পুরো ছাত্র সংগঠনের বেশ ভালোই যোগান দেয় দুজন। ত্রাণ, চিকিৎসা, স্বাস্থ, দুর্যোগ—এসবে বহুত অবদান আছে ওদের। এরিয়ার লোকের মনোযোগ কেড়েছে নিজের নেতৃত্বের জেরে অথচ বখাটেপনা ছাড়তে পারেনি, তবে সেটার কোনো প্রমাণ থাকে না, বুঝলে!ʼʼ
অন্তূ একটা ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করল, “আমাদের ছুটির মধ্যে কী হয়েছিল ভার্সিটিতে?ʼʼ
তানিয়া চারদিকে ভালোভাবে তাকাল কয়েকবার, বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইল। এরপর নিচু আওয়াজে বলল, “শোনো, তুমি এখনও ছোট। এত বোকার মতো চলবে না। পরিস্থিতি বুঝে চলতে হয়। নয়ত মারা পড়বে।ʼʼ
একটু থেমে বলল, “হামজার বাপ কাউন্সিলর এলাকার, তা তো জানো! আর হামজা রাজনৈতিক নেতাকর্মী। আমাদের কমনরুমের আয়া সালমা খালাকে তো চেনো।
-“জি, চিনি।ʼʼ
-“ওনার বাড়ি হামজাদের ক্লাবের পাশে। ওনার ছোটো ছেলেটার হঠাৎ-ই কী থেকে যেন আঘাত পেয়ে কী হলো! পায়ে ক্যান্সার হলো। এরপর নাকি খালা বাড়ির জায়গা অর্ধেক দাম নিয়ে পাওয়ার-দলিল করে এক হিন্দুর কাছে বন্ধক রেখেছিল, বলা চলে বিক্রিই করেছিল। তবে শর্ত ছিল খালা নির্দিষ্ট সময়ে টাকা পরিশোধ করলে জায়গা ফেরত পাবে, যেহেতু বসত বাড়ি। কিন্তু চিকিৎসা করেও সেই ছেলে বাঁচেনি আর। একবছরের সময় ছিল, খালা সেই সময়ে টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। তার ওপর প্রতি মাসের কড়া সুদের টাকা জমে পুরো জমির দাম উসুল হয়ে গেছিল ওই লোকের। ওই লোক এরপর জায়গাটা খালাকে না জানিয়ে অন্য কারও কাছে বেঁচে দিয়েছিল। তারা এসে তাগাদা দিতে থাকল বাড়ি খালি করার। খালা সময় চেয়ে নিয়েছিল। কিন্তু পরে বিচার শালিশ বোর্ডের কাছে চলে গেল। মানে মেয়র, কাউন্সিলর, এলাকার মাতব্বর, সমাজসেবকেরা সব ছিল। সব শেষে নাকি বিশাল ঝামেলা হয়েছিল। পরে হামজা আর জয় মিলে সালমা খালাকে সময় দিয়েছিল আরও কিছুদিন। তখন খালার বড়ো ছেলের বউ বাপের বাড়ি জায়গা বিক্রি করে এনে টাকা দিয়েছিলেন কাউন্সিলর হুমায়ুন পাটোয়ারীর কাছে। পরে আর খালা টাকা নিয়ে আসেনি। এরপর বেশ কয়েকবার হামজা ভাই বাড়ি খালি করতে বলেছিল খালাকে। তারা যায়নি, তাদের যাওয়ার জায়গা নেই। কয়েকদিন হলো খালার মেয়ে আঁখিকে পাওয়া যাচ্ছে না। লোকে বলছে এদের মধ্যেই কেউ হয়ত আঁখিকে তুলে নিয়ে গেছে। জানা নেই মেয়েটার সঙ্গে কী হয়েছে, কী হালে আছে..ʼʼ
ভার্সিটির ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়েও বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ আন্দোলন চলছে, আওয়াজটা খুব কানে বাজছে, নিকাবের নিচে মুখটা ঘেমে উঠেছে। পানি পিপাসা বোধ করল অন্তূ। সে কি কোনো ভয়ানক পরিণতির আভাস পেল আজ! আঁখি! দেখেনি কখনও মেয়েটাকে, তবু হৃদযন্ত্রটা খুব লাফাচ্ছে! আচ্ছা! আঁখি কোথায়? পাওয়া যাচ্ছে না কেন ওকে?
—
এরপর দু'দিন আর ভার্সিটিতে যায়নি অন্তূ। তার সাহসে জুটছে না। সেদিন জয়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ভয় হয়নি, অথচ আজ দু'দিন বুকে ভারী শঙ্কা চেপে আছে। আঁখি মেয়েটাকে সে দেখেনি কখনও, নাম ছাড়া কিছু জানা নেই। তবুও আজ দুটো দিন ঘরে বন্দি হয়ে ওই অপরিচিতা মেয়েটার জন্য পরাণ দাপায়। নিজের পরিণতি সম্বন্ধে মাথায় চেপে বসে অকল্পিত এক ভয়!
বাড়ির দরজায় ধাক্কা পড়ল। অলস ভঙ্গিতে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো সে। মার্জিয়া ভেতরে ঢুকে হাতের ব্যাগটা ধপ করে মেঝেতে রাখল। অন্তূ বলল, “কী হয়েছে, ভাবী! ভাই আনতে যায়নি?ʼʼ
মার্জিয়া জবাব দিলো না। অন্তূ আবার বলল, “আপনি বোরকা খুলে আসুন, আমি খাবার আনছি, একসাথে খাই।ʼʼ
মার্জিয়া খ্যাকখ্যাক করে উঠল, “অ্যাই, নাটক করবা না তো, অন্তূ! সহ্য হচ্ছে না গায়ে।ʼʼ
অন্তূ স্বাভাবিকভাবে বলল, “ঠিক আছে। গায়ে একটু ঠান্ডা পানি ঢেলে আসুন। ভালো লাগবে।ʼʼ
ছ্যাঁত করে উঠল মার্জিয়া, “তোমার মতো ডাইনির মুখে এর চেয়ে ভালো পরামর্শ শোনার আশা রাখিই বা কই আমি? কথাই বলো গা জ্বালানো সব।ʼʼ
-“কী হয়েছে? ক্ষেপে আছেন কেন? কার রাগ আমার ওপর দেখাচ্ছেন?ʼʼ
-“তোমার মতো মা তা রী ননদ থাকতে রাগ আর কার ওপর হবে?ʼʼ
অন্তূর কণ্ঠস্বর দৃঢ় হয়ে উঠল, “মুখ সংযত করুন আপনার। আপনি জানেন, বেশিক্ষণ আমি আপনার অহেতুক কথাবার্তা নিতে পারব না।ʼʼ
-“কী করবা তুমি? আমার বোনের সংসার যেভাবে খাইতে লাগছো তোমরা, আমারেও তাড়াবা এইখান থেকে?ʼʼ
অন্তূ কপাল জড়িয়ে তাকাল ভাবীর দিকে, “তেমন কোনো কথা ওঠেনি, সেটা জানেন আপনিও। আপনি সাধারণ বিষয়কে নিজের ভেতরের জটিলতা দিয়ে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন।ʼʼ
রাবেয়া যোহরের নামাজে বসেছিলেন, দ্রুত সালাম ফিরিয়ে উঠে এলেন, “কী হইছে, মার্জিয়া। কীসব কথা এইসব?ʼʼ
মুখ ঝামটি মারল মার্জিয়া, “শখ আমার খুব যে, তাই।ʼʼ
অন্তূ বলল, “ভনিতা না করুন বলুন, আমি কী করেছি? আপনার শখ পরেও মেটাতে পারবেন।ʼʼ
মুখ বিকৃত করল মার্জিয়া, “জানো না তুমি, না? আমার বোনের সংসার তোমাদের জন্যে যদি ভেঙেই যায়, তখন দেখবা আমি তোমারেও এই বাড়িতে শান্তিতে থাকতে নআ দিয়ে কেমন হিরহির করে টেনে বের করে দিয়ে আসি।
রাবেয়া গর্জে উঠলেন এবার মৃদু স্বরে, “আমার মেয়েকে বের করার বা রাখার তুমি কে? আমার মেয়ের বাপ-মা মরে যায় নাই এখনও যে, তুমি আমার মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করবা! এখনও বেঁচে আছে আমার মেয়ের বাপ। কী হইছে, তা বলবা না? না তা তো জানাই নাই তোমার। এত রহস্য করা ক্যান, হ্যাঁ?ʼʼ
মার্জিয়া চিটপিট করে উঠল, বলতে পারলে তো হতোই। বলতে পারিনা তো আম্মা। আর না সইতে পারি। আমার বোনের ঘর ভাঙলে আপনার মেয়েকে দেখি এই বাড়িতে রাখে কে?ʼʼ
অন্তিক বাড়িতে ঢুকল, “কী ব্যাপার! কীসের চেঁচামেচি চলতেছে?ʼʼ
রাবেয়া বললেন, রাবেয়া গর্জে উঠলেন এবার মৃদু স্বরে, “আমার মেয়েকে বের করার বা রাখার তুমি কে? আমার মেয়ের বাপ-মা মরে যায়নি এখনও, যে তুমি আমার মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করবা! আমার মেয়েকে তাড়াবা, তার আগে আমি বের করতে পারব না তোমায়? এখনও বেঁচে আছে আমার মেয়ের বাপ।ʼʼমার্জিয়া কী কয়, কিছুই বুঝিনা। এমন অশান্তি কয়দিন দেখা যায় ক তো! কী হয়, কীসের কথা কয়, কিছুর কথাই বুঝিনা। তোর বাপের কানে গেলে ভালো হইতো বিষয়টা?ʼʼ
মার্জিয়া স্বামীর দিকে তাকাল। অন্তিক চোখ ফিরিয়ে চুপচাপ রুমে চলে যায়। বোন, স্ত্রী অথবা মা—কাউকেই একটা শব্দও বলল না।
অন্তূ ঘৃণিত চোখে চেয়ে রইল বড়ো ভাইয়ের চলে যাওয়ার পানে। একরাশ ভাঙাচোরা যন্ত্রণা আর ঘেন্না বোধহয় জড়িয়ে এলো বুকটায়। তরতরে যুবক অন্তিকের এক অ-পুরুষ হয়ে ওঠার গল্পটা অস্পষ্ট তার কাছে।
এভাবেই কতগুলো বছর কাটছে এ বাড়িতে। অন্তিক শুধু একটা দেহ মাত্র, যে গোটাটাই মানসিক অস্তিত্ব ও বিবেকবোধমুক্ত।
সে বহুদিন ভাইয়ের সাথে প্রয়োজনীয় ছাড়া অপ্রয়োজনীয় কথা বলে না, হাসে না, একসাথে খায় না। এক অপরিকল্পিত অনীহা এবং বিতৃষ্ণা জেগেছে সবকিছু বুঝে নির্বিকার থাকা অন্তিকের ওপর। মার্জিয়া অকারণেই চিৎকার চেঁচামেচি করে, কেন করে, কীসব বলে, কিছুই বোধগম্য হয়না। আর না অন্তিক কিছু বলে।
শিক্ষিত, তরতরে যুবক অন্তিক। যার পড়ালেখা, সামাজিক সক্রিয়তা, মেধা, কথাবার্তা, হাসি—একসময় সমাজে আলোচিত বিষয় ছিল। আমজাদ মাস্টারের যোগ্য ছেলে থেকে অযোগ্য বিবেকহীন মূর্খ কাপুরুষের জন্মটা কবে যেন! গোটাটাই রহস্য, ঠিক তেমনই মার্জিয়ার আচরণও!
সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি, একটু আগে যে অল্প খিদে পেয়েছিল, তা এখন আর অনুভব হচ্ছে না অন্তূর। আস্তে করে নিজের ঘরে চলে গেল। পেছনে রাবেয়া বেগমের ফুঁপানোর আওয়াজ পেল, ফিরে তাকাল না। অবলা মা তার, আব্বু বাসায় নেই।
পঞ্চগড় গেছেন। আজ ফেরার কথা ছিল, হয়ত ফিরবেন না। অন্তূ পড়ার টেবিলে বসল। অথচ মাথায় আব্বু আর অন্তিকের কথা ঘুরছিল। বই বন্ধ করে টেবিলে মাথা এলিয়ে দিলো। অস্থির লাগছে ভেতরটায়।
চলবে...
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভালোবাসার গল্প | অবরুদ্ধ নিশীথ | পর্ব - ০২ এই পোস্ট টি পড়ার জন্য। আপনাদের পছন্দের সব কিছু পেতে আমাদের সাথেই থাকবেন।