আমাদের চ্যানেলে ঘুরে আসবেন SUBSCRIBE

আদুরি পাখি ওয়েবসাইটে আপনাকে স্বাগতম™

সম্মানিত ভিজিটর আসসালামুয়ালাইকুম : আমাদের এই ওয়েবসাইটে ভালোবাসার গল্প, কবিতা, মনের অব্যক্ত কথা সহ শিক্ষনীয় গল্প ইসলামিক গল্প সহ PDF বই পাবেন ইত্যাদি ।

  সর্বশেষ আপডেট দেখুন →

ভালোবাসার গল্প | অবরুদ্ধ নিশীথ | পর্ব - ০৮

Please wait 0 seconds...
Scroll Down and click on Go to Link for destination
Congrats! Link is Generated

 #অবরুদ্ধ_নিশীথ

#তেজস্মিতা_মুর্তজা


৮.

মার্জিয়ার চাচার বাড়ির লোকসকল আসছে। মার্জিয়া রান্না করছে যত্ন করছে। রাবেয়াও  টুকটাক উৎসাহী। অন্তূকে বুঝিয়েছেন, দেখতে এলেই বিয়ে হয়না। তাছাড়া কুটুমও। আমজাদ সাহেব বাজার গেছেন হালকা পাতলা দই-মিষ্টির ব্যবস্থা করতে! 


অন্তূর বুক ভার, মুখ গম্ভীর। টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে বইয়ে নজর বুলাচ্ছে। জানা নেই লোকগুলো কেমন হবে, তাদের সামনে বসার পর কী প্রশ্ন করবে, শেষ অবধি কী হবে! জীবনসঙ্গী আব্বুর মতো হতে হবে, কথা শেষ। অবশ্য এটুকু ভরসা আছে, যেন-তেন কারও কাছে সম্বন্ধ করবেন না আমজাদ সাহেব। বই ছেড়ে উঠে পড়ল, পড়ায় মনোযোগ আসছে না। 


আলো-বাতাসপূর্ণ ঘরটা আমজাদ সাহেব অন্তূকে দিয়েছেন। বারান্দায় কিছু টব রাখা আছে। অ্যালোভেরা, পাথরকুচি, নয়নতারা, পাতাবাহার গাছ আছে। বারান্দা থেকে আলো ঠিকরে আসছে রুমে। রুমের মাঝে কিছুক্ষণ পায়চারী করল। 


পরনে কালো সেলোয়ার-কামিজ। ওড়নাটা সিল্ক সুতির, গায়ে জড়ানো, যার আঁচল মাটি ছুঁয়ে ঝুলছে। চুলের বেণী খুলেছে অল্পক্ষণ, চুলগুলো এলোমেলো। ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া আসছে বারান্দার গ্রিল ভেদ করে খোলা দরজা দিয়ে ঘরের ভেতরে। অন্তূ পায়চারী করতে করতে হঠাৎ-ই গেয়ে উঠল গুনগুনিয়ে,


~আগে কত বৃষ্টি যে দেখেছি শ্রাবণে, জাগেনি তো এত আশা, ভালোবাসা এ মনে...


অন্তূ থমকাল। সে এমন যুবতী সুলভ আচরণ সচরাচর করেনা! মুচকি হাসল। 


ফর্সা দেহে কালো পরিচ্ছদ দারুণ চমকাচ্ছে, তার ওপর সূর্যরশ্মির প্রতিসরণাঙ্কন ঝিকিমিকি করে উঠছে মাঝেমধ্যেই! বাড়ির দরজায় কেউ এসেছে। পায়চারী থামাল, আবার শুরু করল।


 আমজাদ সাহেব ফিরেছেন। রাবেয়া দরজা খুললেন। দৃশ্য অন্যকিছু। তিনটে যুবক দাঁড়িয়ে আছে। জয়ের পরনে চিরায়ত সাদা থানের লুঙ্গি। ছিপছিপে লম্বা দেহটাতে লুঙ্গি বেশ মানায় তার সাথে। হাসিমুখে সালাম দিলো সুন্দর করে, “আসসালামুআলাইকুম, চাচিমা! আমি জয় আমির! মেম্বারের ভাগ্নে!ʼʼ


রাবেয়া পিছিয়ে দাঁড়িয়ে হাসলেন, “ওহহো জয়! আয় আব্বা, ভিতরে আয়!ʼʼ


জয় ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “আপনি চেনেন আমাকে?ʼʼ


-“চেনবো না? রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার দেখি তো! হামজার পাশে তোমার ছবি দেখি!ʼʼ


জয় চমৎকার লাজুক হাসল। রাবেয়া নাশতা আনতে গেলেন। জয় হাসল। আরমিণের মা খুব লোকসুলভ নারী। এদিক-ওদিক তাকিতুকি করল কাঙ্ক্ষিত মানুষটির দেখা পাবার আশায়। কবীর ও লিমনকে বলল, “মহাদেবের ভক্ত নাকি রে তোরা! আবার আলাদা করে বসার দাওয়াত দেব? বস।ʼʼ


অন্তূর রুম থেকে হালকা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। অন্তূর ধারণা মেহমান এসেছে। পরক্ষণে মনে হলো, পাওনাদার এসে আম্মার সাথে বিবাদ বাঁধিয়েছে! খানিক মানসিক প্রস্তুতির সাথে চুলগুলো হাত দিয়ে একটু এদিক-ওদিক থেকে সরিয়ে দ্রুত কালো ওড়নাটি জড়িয়ে নিলো মাথা-দেহে। ওড়নার বর্ধিত এক প্রান্ত দ্বারা মুখটা ঢাকলো আলতো করে। 


বসার রুমে পা রাখতেই চোখাচোখি হলো জয়ের সাথে। ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠল শরীরটা অন্তূর। থমকানো হাতের শিথিলতায় মুখের আবরণ সরে ঠোঁট ফাঁকা হলো সামান্য! 


জয় চোখ সরালো না বেহায়ার মতো গিললো অন্তূর সুরতটুকু। এর আগে সে তার চপল প্রতিদ্বন্দিনীকে দেখেনি। তার দৃষ্টিতে বহুকিছুর সংমিশ্রণ। প্রথমেক্রূর হাসি ছিল, সেটা এক সময় বিলীন হয়ে অভিভূত হয়েছে চোখদুটো, ধীরে ধীরে সময়ের আবর্তনে তাতে মিশেছে ক্রমশ মুগ্ধতা। বেশি হলে চার সেকেন্ডের ব্যবধানে অঘটন ঘটলো। 


চোখের পলকে মুখের আবরণ তুলে নিলো অন্তূ। মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়াল, “আপনি? আপনি এখানে এসেছেন কেন? বাড়ি অবধি পৌঁছে গেছেন। আগে থেকেই চিনতেন আমার বাড়ি?ʼʼ


জয় নিজস্ব ভঙ্গিমায় নজর ফিরিয়ে নিলো। পায়ের ওপর পা তুলে বসল। সোফার উপরিভাগে একহাত ছড়িয়ে বেশ আরাম করে অন্তূর প্রশ্নের জবাব দিলো, “বাড়িতে অতিথি এলে এভাবে ট্রিট করো, আরমিণ! নট গুড! ছ্যাহʼʼ


-“অতিথি ভেদে আচরণের রঙ ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়!ʼʼ


-“হ। আমারে অতিথি হিসেবে একটু বেশিই পছন্দ হবারই কথা। আফটার অল আমি।ʼʼ


অন্তূ মুখের কাঠামো শক্ত করল। রাবেয়া এলেন। তার মুখে স্মিত হাসি। জয় নিজের ফর্ম চেঞ্জ করে ভদ্র হলো। রাবেয়ার হাতের ট্রের দিকে চেয়ে বলল, “আরে আন্টি! এসব কী? দুটো কথা বলতে এসেছি, তা না শুনে কীসব আয়োজনে লেগেছেন!ʼʼ


-“উমম! ছেলে বেশি কথা বলো।ʼʼ স্বর নরম করলেন, “খা বাপ। ঠাণ্ডা পানি আনি।ʼʼ


অন্তূ হতাশ হলো। তার মা'টা ভীষণ সরল। যেকোনো যুবক-যুবতীকে খাতির করেন। মহানবী যুবকদের ভালোবাসতেন, তাই। জয় এক টুকরো খাবার তুলে দাঁতের আগায় ছোট্ট কামড় দিয়ে রাবেয়ার চোখ বাঁচিয়ে অন্তূকে চোখ মারল। শয়তানের মতো হাসল। রাবেয়াকে জিজ্ঞেস করল, “আজ কোনো আয়োজন আছে নাকি বাড়িতে, চাচিমা? গমগম করছে বাড়ি কেমন?ʼʼ


রাবেয়া হাসলেন, “হ বাপ! আমার ছেলের শশুরবাড়ির লোক আসবে, সাথে অন্তূরে দেখতে আইতেছে।ʼʼ


জয় ভ্রু উচিয়ে হাসল, “আচ্ছা!ʼʼ


অন্তূ মায়ের ওপর বিরক্তিতে দাঁতে দাঁত খিঁচল। কিন্তু ভেতরে গেল না। কী উদ্দেশ্যে এসেছে জয় আমির, তা অনিশ্চিত। রাবেয়া জিজ্ঞেস করলেন, “ক্যান আইছিলি বাপ?ʼʼ


জয় হাসল, “আসলে চাচিমা! ক্লাবের চাঁদা নিতে এসেছিলাম। জোর জবরদস্তি নেই কোনো, ইচ্ছে হলে..


রাবেয়া উঠে দাঁড়ালেন, “এমনে বলতেছ ক্যান! পাড়ার ক্লাব তো আমাদের সুরক্ষা, হামজা, তুমি এরা তো সুনার ছেলে। দাঁড়া।ʼʼ


রাবেয়া গেলে অন্তূর ওপর খ্যাকখ্যাক করে উঠল জয়, “আম্মাজান তো ভালোই! তুমি শালি এরম খিটখিটে ক্যান?ʼʼ

অন্তূ ঝাঁজিয়ে উঠল, “দুর্ভাগ্যবশত আম্মা আপনার প্রকৃতি জানে না। কেন এসেছেন সেটা বলুন!ʼʼ


-“তোমারে দেখতে আইছিলাম। তুমি যা খ্যাচড়া!ʼʼ


-“ধন্য করলেন।ʼʼ


জয় ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেল। অন্তূ বেশ শান্ত করে বলল, “আপনাদের ক্লাবের জন্য চাঁদা চাইতে আসতে লজ্জা করল না? কী কাজে লাগে ওই শয়তানের ঘাটি?ʼʼ


জয় হাসল, “বাড়ি বয়ে এসে যদি থাপড়ে যাই, ব্যাপারটা খারাপ দেখাবে না, আরমিণ? চুপ করো, নয়ত তোমার মা টা মানবো বলে মনে হয় না, থাপড়ে চারটে দাঁত উপড়ে দেব। বাড়ি অবধি যখন চলে এসেছি, তোমার টুটি চেপে ধরে দম আঁটকে মারতে কতক্ষণ?ʼʼ


অন্তূ চুপ রইল। সে ভয় পাচ্ছেনা, এমন নয়। জয়ের মতো উগ্র ছাত্রনেতাদের ভয় পাওয়াই তো নিয়ম। ওরা জঙলি। 


জয় মুখ ভেঙচায়, “আজ নাকি বলি দেয়া হবে তোমার। কোন মনসুর আসতেছে দেখতে?ʼʼ


নজর ঘুরিয়ে পুরো আপাদমস্তক উপর-নিচ করে দেখল অন্তূর। ভালোই লাগছে তার। অন্তূ সেই নজর লক্ষ্য করে জমে গেল যেন। বাড়ি বয়ে এসে এক অমানব তার শরীর মাপছে। আল্লাহ পাক কবে পিছু ছাড়াবেন এই শয়তানের থেকে? রাবেয়া উৎফুল্ল পায়ে রুমে ঢুকলেন। তার হাতে জড়ানো, মুচরানো দুটো শ টাকার নোট। জয় কবীরকে ইশারা নিতে। রাবেয়া বললেন, “চলবে এতে?ʼʼ


টাকা জয় দেখেইনি। তার নজর ছিল অন্তূর শরীরে। দ্রুত মাথা হেলিয়ে বলল, “চলবে? হ্যাঁ হ্যাঁ চলবে, চাচিমা। না চললে ধাক্কা মারব।ʼʼ


আমজাদ সাহেব ভেতরে ঢুকে একটু অবাক হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে সালাম দিলো জয়, “আসসালামুআলাইকুম, কাকা! ভালো আছেন? শরীর-টরীর ভালো!ʼʼ


আমজাদ সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে গম্ভীর হাসলেন, “ভালোই। কী ব্যাপার?ʼʼ


জয় বলল, “এইতো কাকা, বিশেষ কিছু নয়!ʼʼ


-“কবে এসেছ ঢাকা থেকে?ʼʼ


-“দিন কয়েক হলো। আপনি নাকি রিটায়ার করেছেন?ʼʼ


-“করতে তো সকলকেই হয় রে, বাপ।ʼʼ


আমজাদ সাহেব ভেতরে ঢুকে গেলেন। অন্তূ গেল না।  রাবেয়া জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার আব্বা-আম্মারা সব ভালো আছে তো ,জয়?ʼʼ


জয় একটু বিপাকে পড়ল যেন এবার। ঠোঁট কামড়াল, “ওপারে ভালোই আছে মনেহয়। মরার পর আর দুঃখ কীসের মানুষের?ʼʼ


আঁতকে উঠলেন রাবেয়া, “সেকি! কেউ নেই?ʼʼ


জয় জবাব দিলো না। অন্তূ এই প্রথম জয়ের মুখটা কিঞ্চিৎ শুকনো দেখল, প্রথমবার রসিক জয়কে গম্ভীর দেখালো। রাবেয়ার মায়া হলো তাগড়া ছেলের ওমন নীরব অপারগ মুখ দেখে। সস্নেহে কাছে গিয়ে বসে চুলে হাত বুলালেন, “একা থাকো বাড়িতে?ʼʼ


জয় মাথা নাড়ল, “মামার কাছে থাকি। আচ্ছা, আজ আসি। আবার আসব!ʼʼ


রাবেয়া বলল, “আবার আসবে। মাঝেমধ্যেই আসবে কিন্তু। জয় বলে ফেলল, “আচ্ছা, আম্মা! চাচিআম্মা।ʼʼ ভুলেই বলল অথবা ইচ্ছে করে বোঝা গেল না।


-“আম্মা বললে পাপ হবে নাকি? বলতে মন চাইলে বলবে!ʼʼ


যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে ফিরে তাকাল অন্তূর দিকে। ঠোঁটের কোণে বাজে হাসি। অন্তূ চোখ নামিয়ে নিলো। বুকে অস্থিরতা, আতঙ্ক।


জয় বেরোনোর সময় সেদিন পাড়ার দুটো মহিলা ঢুকেছিল অন্তূদের বাড়িতে। জয় সহ কবীর, লিমনকে ঘুরে ঘুরে দেখছিল তারা। অন্তূর ভয় হলো। বাঁকা নজর, বাকা চিন্তাধারা মহিলাদের! না-জানি কোথায় গড়ায় এই নীরব দৃষ্টি। 


বাইরে বেরিয়ে রোদচশমা চোখে লাগাল। বাইরে রোদ। কবীর বলল, “ভাই! আমাদের ক্লাবের চাঁদার জন্য তো আগে এইদিক আসা হয় নাই!ʼʼ


-“তাতে কী?ʼʼ


-“গতকালের পিকনিক আজ আছে, সেইজন্য টাকা নিলেন?ʼʼ


জয় বিরক্ত হলো, “তোর মনে হয়, আমাদের পিকনিক এসব টাকায় হয় বা হবে? গু খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস, নাকি বেশি খাচ্ছিস? এ ব্যাপারে আর প্রশ্ন করিস না।ʼʼ


কবীর গোমরা মুখে বলল, “কী করব এই টাকার?ʼʼ


জয় হাসল, “কত দিয়েছে?ʼʼ


-“দুইশো!ʼʼ


-“যা, আর কিছু লাগিয়ে এক প্যাকেট ব্যানসন এণ্ড হ্যাজেস আন। যদি হয়, তো এক বোতল বাংলা মালও আনতে পারিস। পিকনিকে যতক্ষণ রান্না শেষ না হয়, চলবে।ʼʼ


ক্লাবের পেছনে বিশাল খোলা মাঠ। সেখানে ব্যাডমিন্টনের তারজালি টানানো, লাইট লাগানো হয়েছে, কোট আঁকানো হয়েছে। কেউ কেউ র‌্যাকেট দিয়ে শার্টল কর্ক টুকাচ্ছে সেখানে। 


ক্লাবের দোতলা মরিচা ধরা বিল্ডিং। দোতলার ওপরে পেছনের দিকে, মাঠের ওপরে খোলা বারান্দা বা ছাদ অথবা সিঁড়িঘরের মতো। সাত-আটজন ছেলেরা দাঁড়িয়ে-বসে আছে সেখানে। অর্ধেক কার্নিশের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আপনমনে সিগারেটের ধোঁয়া গিলছে জয়। এই সময় সে গা গরম রাখতে ব্যাডমিন্টনে নেমে পড়ে। জম্পেশ পিটিয়ে যায়। ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে যায় শরীর। 


আজ রান্নার কাছে না গিয়ে বরং উদাস চোখে ওপরে উঠে এসেছে গিটারটা কাধে নিয়ে। তারপর থেকে একটা করে সিগারেট জ্বালাচ্ছে।


হামজা ঢুকল। সকলে একযোগে দাঁড়িয়ে সালাম ঠুকল।  হামজা জয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী ভাবছিস?ʼʼ


-“ভাবছি না।ʼʼ


-“কী হয়েছে, কোনো সমস্যা?ʼʼ


-“সমস্যাই তো।ʼʼ


-“কী?ʼʼ


জয় তাকাল, “আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, আমার জীবনে কোনো সমস্যা নাই। এই সমস্যাটা একটা সমস্যা না, ভাই?ʼʼ


হামজা গম্ভীর মুখে বলল,“সিগারেটটা দে।ʼʼ


জয় দিলো না। হামজা কেঁড়ে নিলো সিগারেটটা জয়ের ঠোঁট থেকে। তাতে টান দিয়ে বলল, “ভাবুক হয়ে আছিস কেন?ʼʼ


-“আজ আরমিণকে দেখলাম।ʼʼ


-“বিশেষ কিছু?ʼʼ


-“না, নতুন কিছু।ʼʼ


তাকায় হামজা। জয় স্বগতোক্তি করে, “চেহারা দেখেছি আজ ওর, ভাই।


-“তাতে কী?ʼʼ 


-“শালী মেলা সুন্দরী আছে। মানে বহুতই তো দেখছি, এত ভালো লাগে নাই কাউরে দেইখা! একদম যারে কাড়াক টাইপের সুন্দরী! কী চোখ, নাক, ঠোঁট, মাইরি! তাক লাইগা গেছিল আমার, সিরিয়াসলি।ʼʼ


হামজা হেসে ফেলল, “মাথার সার্কিট ফিউজ হয়ে গেছে তোর?ʼʼ


-“হ। আগে বহু মাইয়া দেখছি, মাগার আমারে বিশেষভাবে আকর্ষণ করবার পারেনাই। আগেও ওর চোখ দেখছি, কিন্তু সেই রকমভাবে খেয়াল করি নাই। আজ কিছুক্ষণ খালি ভ্যাবলার মতো চাইয়া দেখছি। ছ্যহ! এমনিই যে ভাব শালীর, আবার যদি এমনে ঠুটকা খাই তাইলে তো...ʼʼ


-“অবশেষে বিশাল সমস্যায় পড়েছিস। অর্থাৎ তোর সমস্যা শেষ।ʼʼ


জয় হামজার চোখে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠল, সাথে হামজাও। চট করে হাসি থামিয়ে বলল, “ইচ্ছে করে কানের নিচে চাইর খান বাজাই!ʼʼ


কথা শেষ করে ঢোক গিলল, যেন কথা ফুরায়নি তবুও থামল জয়। হামজা হাসল, “এরপর?ʼʼ


জয় হাসফাস করে উঠল, “এরপর থেকে শান্তি লাগতেছে না। বুকে বড় জ্বালা। আকাশের দিক তাকায়া আছি, মাঝেমধ্যেই ফর্সা মুখটা ভাইসা উঠতেছে। যেমনে আগে সিনেমায় দেখতাম, চিঠির পাতায় চিঠি প্রেরকের মুখ, ওমনে।ʼʼ


-“দেখতে খুব ভালো?ʼʼ


-“না। মেলা ফর্সা!ʼʼ নিজের হাতের পিঠ দেখিয়ে বলল, “মানে আমার গায়ের রঙের সাথে মিলবে না। হিংসা হচ্ছে আমার। আমার সাথে দাঁড়ালে আমারে কালা লাগবো দেখতে। কালা জামার ভিতর দিয়া হাটা সেই ফর্সা দেখা যাইতেছিল..ʼʼ


হামজা হেসে ফেলল, জয়ের আর সব ফিউজ হয়ে গিলেও সে জীবনে নিজের ভাব নষ্ট করে কারও তারিফ করে না। জীবনে একটা প্রেম করেনি। গার্লফ্রেন্ডের নাকি কথা মানতে হয়, তারিফ করতে হয়, রাগ মানাতে হয়! জয় নিজেও কপালে হাত রেখে চোখ বুজে হেসে ফেলল। ধপ করে চেয়ারে বসে হাসিমুখেই ঘাঁড়ে হাত ঘষে আকাশের দিকে চোখ বুজে মুখ তুলে আড়মোড়া ভাঙল। হঠাৎ-ই বলে উঠল, “আরমিণকে লাগবে আমার!ʼʼ


হামজা সিগারেট ফেলে দিলো, “লাগবে? গ্রোসারি শপের পণ্য নাকি?ʼʼ


-“ভাই, জ্বালানোর জন্য হইলেও লাগবে। আমার তো এই টুকুও সহ্য হইতেছে না, আমি ছাড়া কেউ ওরে দেখবো! আজ নাকি কোনো শালার ছেলে দেখতে আসছিল ওরে, ওই শালারে পোন্দাতে মন চাইতেছে। এই শালা কবীর আর লিমনও দেখছে। এই শালা, তোরা তাকাইছিস ক্যা? চোখ সংযত রাখতে পারো না শালা? পুরুষের মূল গুণ হইলো, চোখের পর্দা করা। কিলবিল করে, না?ʼʼ


কবীর জিজ্ঞেস করল ইতস্তত করে, “ভাই, আপনে কি মাইয়ার প্রেমে পড়ছেন?ʼʼ


গলা কাঁপিয়ে হাসল জয়, “হ। অত্যাধিক মাত্রার প্রেম। এই প্রেমের খাতিরে ওই চেংরিরে কুরবান করতেও রাজী আছি রে কইবরা!ʼʼ


সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল, “ওসব আমার সিলেবাসের নাই হে! প্রেম হচ্ছে একটা কামিটমেন্ট, মানে আঁটকে থাকা। জয় আমির কোথাও কখনও কামিটেড হতে পারে না। ওসব ভুদাইদের কামকাজ। মেয়েবাজি আলাদা বিষয়, কিন্তু ওসব কাব্যিক প্রেম-পিরিতি আমার সিস্টেমে নাই! ছোটোলোকি কারবার।ʼʼ


নেমে গেল গিটারটা কাধে করে খোলা ছাদ থেকে। হামজা নেমে এলো জয়ের পিছু পিছু। বেশ ঠান্ডা পড়েছে। একটা স্লিভলেস শার্ট গায়ে জয়ের। কালো জ্যাকেটটা ঝুলছে কাধের ওপর। 


বেশ কিছুক্ষণ একটানা র‌্যাকেট পিটালো। গা ঘেমে প্যাকপ্যাকে হয়ে উঠল। চিৎকার করল মিউজিক বক্সের পাশে বসা থাকা ছেলের ওপর, “গানের সাউন্ড বাড়া! ভাত খাও নাই শালা, দুপুরে! এনার্জি ড্রিংক কিনে এনে দেই একখান?ʼʼ


ধুম-ধারাক্কা গান বাজছে। জয় একাধারে র‌্যাকেট পিটিয়ে গেল। শার্টল কর্ক সামনে আসছে তো গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে পিটিয়ে যাচ্ছে। একবারও মাটিতে পড়ার সুযোগ দিলো না। এমনভাবে দাঁত খিঁচে খিঁচে পিটিয়ে আঘাত করছে যেন কোনো চাপা ক্ষোভ ঝারছে ওই পেটানোতে। 


ক্লান্ত হয়ে এসে ভেজা ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল।


এই পথ আগেরই মতোন, ঠিক তেমনই আছে

এই রাত সেই রাতের কত কথা বলে..

চলে যাওয়ার বিষাদ সুর, এখনও হৃদয়ে বাজে

তারপরেও কেন যেন এইখানেই ফিরে আসে

সব ভুলে গিয়ে আবার হারাতে চাই…


তারপরেরটুকু আর গাইল না। আবার নতুন সুর তুলল গিটারে। এবারে ঝাঁজাল সুর উঠছে। ছেলেরা বিমোহিতের মতো ঢুলছে তালে তালে। জয়ের প্রানোচ্ছল চঞ্চলতা ক্লাবের ছেলেদের প্রাণশক্তি যোগায়। ওরা নেশাক্ত একেকটা জয়ের ওপর। 


জয়ের গানের গলা অদ্ভুত সুন্দর। কেমন এক গা ছমছমে মাথায় কেঁপে ওঠে গলাটা! যখন সে গলা ছেড়ে ব্রান্ড পার্টির মতো মাথা নাড়িয়ে পাগলের মতো গান গায়। জয় আবার গাইল, 


            তুমি কি দেখেছ কভু, জীবনের পরাজয়

    দুঃখের দহনে করুণ রোদনে তিলে তিলে তার ক্ষয়


সকলে বিমোহিতের মতো চেয়ে রয় জয়ের বোজা চোখ দুটোর পানে। গলা ছেড়ে, মনের গভীর থেকে গান গাইছে। একমাত্র বোধহয় গান গাওয়ার সময় জয় মনের গভীরে ডুব দেয়, অন্যথায় তাকে কখনও সিরিয়াস বা ইমোশোনাল হতে দেখা যায় না। অথচ এই গিটার তার বহিঃপ্রকাশ, অল্প একটু সত্যতা আর পরম স্নেহের ধন। আবারও অন্য সুর তুলে গলা বাজিয়ে চেঁচিয়ে গাইল, 


                     খাঁজার নামে পাগল হইয়া,

                   ঘুরি আমি আজমীর গিয়া রে

       এত করে ডাকলাম তারে, তবু দেখা পাইলাম না

             ওরে পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না, ওরে ....

                  মন পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না..


রান্নার কাজে এসব দেখাশোনায় খুব পটু। নিজের একার তদারকিতে ক্লাবের শত শত ছেলেকে পালছে। যারা ওর পাপ দেখেনা।


হাতাটা হাতে নিয়ে মাংসে নাড়া দিতে গলা ছাড়ল, 


                     তুই পাগল তোর মন পাগল

                        পাগল পাগল করিস না

                     পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না...


হামজা ফোনে কথা বলছিল। দেখে মনে হয় সহ্য হলো না। দৌঁড়ে গিয়ে হামজার কাধে ওঠার চেষ্টা করল। হামজা তাল হারিয়ে পড়ে যেতে নিয়ে আবার ফোন-টোন রেখে মাঠের ওপারেই তেড়ে গেল জয়ের দিকে। জয় ছুটছে অন্ধকারের দিকে, পেছনে তেড়ে দৌড়াচ্ছে হামজা। এখন বেশ কিছুক্ষণ দুজন অন্ধকারে কাটাবে। মাঠের আঁলের ওপর বসে কীসের গল্প জমাবে। হামজার কাধে মাথা রাখবে জয়। এরপর রাত ফুরিয়ে যাবে। 


দুজন দৌড়ে আবার ঘুরে এলো। হামজা হাঁপিয়ে গিয়ে বসল শিশির ভেজা মাঠের ওপর। খানিক বাদে কোত্থেকে দৌঁড়ে এসে হামজার কোলে মাথা রেখে ঠান্ডা ঘাসের ওপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল জয়। 


জয়ের সামনে হামজা নেতৃত্ব ও গাম্ভীর্য কোনোদিন টেকে না। যত সিরিয়াস মুহুর্তই হোক, ওই জয়ের সাধ্যি আছে হামজাকে জ্বালিয়ে এক মুহুর্তে সব পণ্ড করার।


ভোটের হিরিক বেঁধেছে চারদিকে। শোরগোল লেগেছে এলাকা জুড়ে। পোস্টার লাগানোর ব্যস্ততা চলছে চারদিকে। 


পিবিআই কার্যালয়ে নতুন ব্যস্ততা। আঁখির মর্গ-টেস্টের রিপোর্ট এসেছে। মুস্তাকিনের পূর্ব-ধারণা কাঁটায় কাঁটায় মিলেছে। তার সন্দেহ মাফিক কারও বিরুদ্ধেই কোনো প্রমাণ আসেনি রিপোর্টে। মুস্তাকিনের এখন ইচ্ছে করল রিপোর্ট তৈরী করা ডাক্তারের মুখের ভেতরে পিস্তলের নল ঢুকিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করতে, যে কারা আঙুল ঘুরিয়েছে রিপোর্ট অবাস্তব এবং স্ক্রিপটেড তৈরিতে! 


বেশ কিছুক্ষণ রিপোর্ট দেখে সেটা ছুঁড়ে ফেলার মতো টেবিলে ছুঁড়ে ফেলল। এমন কিছুই রিপোর্টে নেই যা দ্বারা অপরাধী শনাক্ত করা যায় বা কোনো ক্লু পাওয়া যায়! পুরো নিরপেক্ষ একটা রিপোর্ট। যেখানে শুধু প্রকাশ পেয়েছে আঁখিকে মারা হয়েছে কীভাবে, তার দেহে কী কী ক্ষতি সাধিত হয়েছে। 


লাশ আঁখির বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। এখন আর ওদের বাড়িতে গিয়ে বিশদ জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া এই কেইস টানার এনাদার কোনো ওয়ে রইল না। 


মুস্তাকিন বেরিয়ে এলো নিজের কেবিন থেকে। বাইরে কিছু কাজবাজ রয়েছে। 


বোরকায় আবৃত একটা মেয়ে এগিয়ে আসছে কার্যালয়ের ভেতরে। দাঁড়াল মুস্তাকিন, ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল। মেয়েটাকে চোখে পরিচিত লাগছে। ভার্সিটি চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল, ধাক্কাও খেয়েছিল তার সঙ্গে এই মেয়েটাই!


চলবে..


[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভালোবাসার গল্প | অবরুদ্ধ নিশীথ | পর্ব - ০৮ এই পোস্ট টি পড়ার জন্য। আপনাদের পছন্দের সব কিছু পেতে আমাদের সাথেই থাকবেন।

إرسال تعليق

Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.
A+
A-
দুঃখিত লেখা কপি করার অনুমতি নাই😔, শুধুমাত্র শেয়ার করতে পারবেন 🥰 ধন্যবাদান্তে- আদুরি পাখি