আমাদের চ্যানেলে ঘুরে আসবেন SUBSCRIBE

আদুরি পাখি ওয়েবসাইটে আপনাকে স্বাগতম™

সম্মানিত ভিজিটর আসসালামুয়ালাইকুম : আমাদের এই ওয়েবসাইটে ভালোবাসার গল্প, কবিতা, মনের অব্যক্ত কথা সহ শিক্ষনীয় গল্প ইসলামিক গল্প সহ PDF বই পাবেন ইত্যাদি ।

  সর্বশেষ আপডেট দেখুন →

ভালোবাসার গল্প | অবরুদ্ধ নিশীথ | পর্ব - ০৫

Please wait 0 seconds...
Scroll Down and click on Go to Link for destination
Congrats! Link is Generated

 #অবরুদ্ধ_নিশীথ

#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৫.


ঝিরঝিরে বৃষ্টি নেমেছে বাইরে। হামজা এলো রাত এগারোটার দিকে। দোতলার সিঁড়িতে ছাতা বাঁধিয়ে রেখে ভেতরে ঢুকল। রিমি বসে ছিল স্বামীর অপেক্ষায়। 

দোতলার সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই একপাশে ডাইনিং রুম, তার আরেক বিভাজনে বসার ঘর। রিমি উঠে এগিয়ে গেল স্বামীর দিকে, হামজার হাত থেকে ওয়ালেট, ফোন, এবং ভেজা হাতঘড়িটা নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এত দেরি হলো কেন? হাতে কী হয়েছে আপনার? ভিজেছেন কেন, ছাতা ছিল না সাথে?ʼʼ


সাদা পাঞ্জাবীতে কাদার ছিটে। হামজা সব কথা এড়িয়ে তা ঝারতে ঝারতে বলল, “একটা গামছা দাও, আগে।ʼʼ


রিমি বুঝল, কোনো কারণে মেজাজ থমকে আছে আপাতত লোকটার। বাকি সময় যে হৈ হৈ করে তাও নয়। গামছায় মাথা মুছতে মুছতে তরুকে ডাকল হামজা, “তরু! এদিকে আয়!ʼʼ


তরু বেরিয়ে এলো, “কী হয়েছে, বড়ভাই?ʼʼ


-“তুলিকে ডাক!ʼʼ 


হাত মুখ ধুয়ে পাঞ্জাবীর বোতাম খুলতে খুলতে এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে। রিমি রান্নাঘরে ছুটল। তরু ফিরে এসে, আস্তে করে বলল, “ভাই! আপু আসতে চাইছে না। খাবে না।ʼʼ


-“তুই খেতে বস।ʼʼ


শাহানা এসে রিমিকে ভাতের পাত্র আনতে ইশারা করে বসলেন হামজার পাশে। বললেন, “ওই বাদর ফিরবে না? কত রাত হলো, বাড়ি ফেরে কখন সে?ʼʼ


হামজা গামছায় মাথা মুছতে মুছতে বলল, “যখন ফেরে প্রতিদিন, তখনই ফিরবে। আপনি বসুন।ʼʼ


-“তা ক্যান ফিরবে? তুই শাসন করার বদলে আশকারা দিয়েই দিন দিন বেয়ারা বানাইছিস ওরে!ʼʼ


-“নির্বাচনের ঝামেলা এগিয়ে আসছে। এখন একটু ব্যস্তই থাকবে। এই নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করার কী আছে? জয় ছোট বাচ্চা না আম্মা। ওকে নিয়ে টেনশন করতে হবে কেন? আপনি বসুন। শরীর ভালো আপনার?ʼʼ


-“ভালো।ʼʼ


ভাত তুলে দিলেন শাহানা হামজার প্লেটে। একটু নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “নির্বাচন আসতেছে বুঝলাম। তোরা কী করতেছিস কিছুই মাথায় ঢুকতেছে না আমার। তোর বাপটা আবার আসবে কখন?ʼʼ


প্লেটে হাত নাড়তে নাড়তে বলল হামজা, “মাথায় না ঢুকে যদি ভালো থাকা যায়, তাহলে আর ঢুকানোর চেষ্টা করবেন না। লবন দিন। বাবা থানায় গেছে। চলে আসবে।ʼʼ


-“গেছে বুঝলাম। আসবে কখন?ʼʼ


-“আপনাকে খেয়ে নিতে বললাম। ওষুধ খাবেন খেয়ে।ʼʼ


হঠাৎ চমকে উঠলেন শাহানা, “থানায়? আবার থানায়? মাইয়া মরল তো মরল, আমার বাড়ির মানুষগুলারে ফ্যাসাদে ফেলে রেখে গেল!ʼ


হামজা বিরক্ত হয়ে তাকাল, “আহ আম্মা! এই আলাপ কেন? বাবা যদি থানা-কাচারি না ঘুরবে, তো মেম্বার হয়েছে কেন? জনগণের সমস্যায় এগিয়ে যাওয়া বাবার কাজ, কাজ করছে সে। থানায় গেলেই তো আর গ্রেফতার হয়ে যাবেনা! আর গ্রেফতার হবেই বা কেন?ʼʼ 


এরপর গলা উঁচিয়ে রিমিকে ডাকল, “রিমি!ʼʼ


রিমি লেবু কেটে এনে দাঁড়াল। হামজার প্লেটে দুটো শশা ও লেবুর টুকরো তুলে দিলো। হামজার ভেজা চুলে আঁচল নেড়ে চুল মুছে দিলো। পাঞ্জাবীর কলারটাও ভেজা। রিমি তা গুটিয়ে দিয়ে গিন্নির মতো চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে রইল।  অসময়ের বৃষ্টিপাত! শীত চলে আসার পর বৃষ্টি নেমেছে আজ প্রকৃতিতে। 


আরও একটা ডিম তুলে দিলেন শাহানা ছেলের পাতে। হামজার ডিম খুব পছন্দ। মাঝেমধ্যেই প্রেশার হাই হয়ে যায় এই বয়সেই, তবু কোনো কিছুতে মান্যি করতে দেখা যায়না তাকে। হামজা খেতে খেতে রিমিকে বলল, “খেয়ে নাও। সবাইকে আলাদা আলাদা করে বলতে হবে?ʼʼ


তরু বারবার পানি খাচ্ছিল। হামজা বলল, “এত ছটফট করছিস কেন? আরাম করে খা।ʼʼ


-“কোয়েল পাখি কাঁদছে, বড়ভাই।ʼʼ


-“তুলি সামলাবে। তুই খা।ʼʼ


শাহানা বললেন, রিমি, তুমি খাইতে বসো। তুলিকে জয় এসে খাওয়াবেনে।ʼʼ


রিমি খেতে বসল না। এখন খেতে বসলে চলবে না। হামজা গোসল করবে, বিভিন্ন প্রয়োজনে দরকার হবে। বলল, “আপনারা খেয়ে নিন। আপনার ওষুধ খেতে হবে। আমি আর তুলি আপু পরে খেয়ে নেব। জয় ভাইয়া আসুক, সকলে একসাথে খাবো।ʼʼ


খাওয়া শেষ করে গোসলে ঢুকল হামজা। রিমি লুঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বাথরুমের আধখোলা দরজার বাইরে। হামজা লুঙ্গি পরে এসে বসল বিছানায়। চুল থেকে পানি পড়ছে এখনও, প্রতিদিন রাতদুপুরে গোসল করার প্রয়োজনীয়তাটা কী? ঠান্ডা লাগে না এই লোকের নাকি? বোঝে না রিমি। তামাটে গায়ের রঙে, পুরু চামড়ার হৃষ্ট-দেহি পুরুষটিকে দেখল চেয়ে ক্ষণকাল রিমি। কোনোদিন ভালোভাবে মাথা মুছে আসেনা। পরে রিমির মুছিয়ে দিতে হয়।


শুকনো তোয়ালে এনে মাথাটা ভালো করে মুছতে মুছতে বলল রিমি, “একটু যত্ন নিলে কী হয় নিজের? এত উদাসীন কেন আপনি?ʼʼ


-“অত যত্ন করার কী? তুমি আছো তো করতে। বিয়ে করাদ একটু ফায়দা হোক।ʼʼ


কডা চোখে তাকাল রিমি। হামজা কপালের ওপর টোকা মারল একটা। রিমি বলল, “হাত কেটেছে কী করে এখনও কিন্তু বলেননি! আবারও বলছি, নিজের খেয়াল রাখবেন।ʼʼ


হাতটা টেনে ধরে কোলে বসাল রিমিকে হামজা। শাড়ির লুটিয়ে পড়ে থাকা আঁচল কাধে তুলে দিয়ে, পেটসহ কোমড় জড়িয়ে ধরল। কপট চিবিয়ে বলল, “আমিই যদি আমার যত্ন নেব, তাহলে তোমাকে তুলে এনেছি কেন?ʼʼ


রিমি মাথাটা নুইয়ে নিলো। গম্ভীর হলো হামজার মুখ, একহাত রিমির কোমড় থেকে সরিয়ে ফোন তুলে কাউকে কল করল। রিমি উঠে দাঁড়াল হামজার হাত ছাড়িয়ে। ভেজা মাথায় আরও দু একবার হাত বুলিয়ে স্যাভলন আর তুলা এনে বসল হামজার পাশে। হামজা ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে দিলো বিরক্ত হয়ে। রিমি তার হাতের ক্ষতটা পরিষ্কার করতে করতে বলল, “দেবর মশাই কল ধরছে না, তাই তো? আশাই বা রাখেন কেন? তার ফোন এখন কোথাও পড়ে আছে, সে হয়ত ফোন থেকে দূরে কোনো বিছানায় পড়ে আছে কারো সাথে!ʼʼ


হামজা ভ্রু কুঁচকে তাকাল, “পুঁচকে মানুষ খুব বুঝতে শিখেছ এ বাড়ির ছেলেকে?ʼʼ


-“এ বাড়ি, ও বাড়ি কী? ছোটো থেকে এসব দেখে বড়ো হয়েছি। না বুঝলেও বুঝতে হয়েছে। কে কী করছে কখন, কার স্বভাব কী! বিশেষ করে রাজনীতিবিদ আর নেতাদের চরিত্র ভালো হতে নেই বলেই জানি।ʼʼ


-“তাই নাকি? তো আমার ব্যপারে কী খেয়াল তোমার? আমি কেমন, তুমি ছাড়াও…ʼʼ


হামজার হাতের ক্ষততে খামচে ধরল রিমি, “জানে মেরে ফেলব একদম! চেনেন তো আমার বাপ-ভাইদের! কেটে ছিঁড়ে খাওয়াব তাদের দিয়ে।ʼʼ


হামজা হেসে ফেলল। হাতের দিকে তাকালো। যেই ক্ষততে মলম লাগাচ্ছিল এতক্ষণ সযত্নে, সেখানে খামচে ধরে আছে, রক্ত বের হচ্ছে নখের আচড়ে। হামজা কিচ্ছু বলল না, তার চোখে দুষ্টু হাসি খেলা করছে, তা খেয়াল করে দাঁত খিঁচে জিদের সাথে বলে উঠল রিমি, “আর জয় ভাইয়ার ব্যাপারে খুব ভালোই জানি।ʼʼ 


রিমি জানে, হামজা জয়ের ব্যাপারে খারাপ কথা সহ্য করতে পারেনা। কাজ হলো ওর কথায়। হামজার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, “অন্য কোথাও তো থাকতে পারে, কোনো বিপদও হতে পারে!ʼʼ


-“তার আর কী বিপদ হবে? সে নিজেই একটা আস্ত বিপদ মানুষের জন্য, বিশেষ করে মেয়ে মানুষের জন্য!ʼʼ


জয়ের ব্যাপারে রিমির এসব ত্যাড়ছা উক্তি শুনতে ভালো লাগছিল না হামজার। গম্ভীর হলো, “তোমার ওপর কোনোদিন খারাপ নজর দিয়েছে?ʼʼ


-“না, তা দেয়নি..ʼʼ


-“তাহলে?ʼʼ


রিমি তাকাল হামজার কঠিন হয়ে আসা মুখটার দিকে। হাতে এন্টিসেপটিক লাগানো শেষ করে উঠে দাঁড়াল। হামজা বলল, “জয় দুষ্টু, বেপরোয়া, অসভ্য, সেসব সত্যি। কিন্তু মিথ্যাবাদী বা বিশ্বাসঘাতক নয়। জানো তো!ʼʼ


রিমি কথা বলল না। হামজা হাত ধরে টেনে এনে পাশে বসালো ওকে। এরপর চট করে পা টান করে শুয়ে পড়ল রিমির কোলে মাথা রেখে। চোখ বুজে বলল, “কথা বলছো না কেন?ʼʼ


-“আমার চেয়ে জয় ভাইয়া বেশি ইম্পর্টেন্ট আপনার কাছে, তা জানি। কিন্তু কেন?ʼʼ


হামজা চুপচাপ শুয়ে রয় চোখ বুজে। জবাব না পেয়ে রিমি জিজ্ঞেস করল, “হাত কেটেছে কীভাবে?ʼʼ


-“দেয়ালে ঠেস লেগেছিল।ʼʼ


-“দেয়ালে ঠেস লাগলে এভাবে কাটে না হাত।ʼʼ


ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল হামজা, “হুঁশিয়ারী করছো আমার সঙ্গে? ইন্টারেস্টিং! তো বলো দেয়ালে ঠেস লাগলে কীভাবে কাটে হাত?ʼʼ 


-“তা জানিনা। তবে মানুষ অথবা লোহা পেটাতে গিয়ে এভাবে হাত কাটে, সেটা জানি। কী পিটিয়ে এলেন?ʼʼ


-“আমার পেশা দুটোই।ʼʼ


-“পেটানো! হাহ!ʼʼ


-“নতুন কী? আমি তো ভদ্রলোক নই, রিমি।ʼʼ


রিমি খানিক মাথা ঝুঁকালো নিচের দিকে, হামজার চাপ দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে ধীর কণ্ঠে বলল, “ক'দিন বাদে আপনি হবেন মেয়র, এরপর মেম্বার অব পার্লামেন্ট। আমি হব তার ঘরনী। আব্বু বলতো, রাজনীতিবিদের বউদের বড়ো রাজনীতিবিদ হতে হয়, তবেই না চলবে সংসার! জানেন! আপনার মতো এমন রাক্ষুসে লোকের সাথে আব্বু আমার বিয়ে দিতে কোনোভাবেই রাজী ছিল না! আমি বললাম, বিয়ে করলে এই রাবনটাকেই করব।ʼʼ 


হামজা খপ করে রিমির হাতটা ধরে ফেলল, আরও শক্ত করে কোল চেপে শুয়ে বলল, “ কেন তোমার মতো পুচকে রাবনকে বিয়ে করতে চাইল? ভয় করল না তোমার, যদি খেয়ে ফেলি?ʼʼ


নিঃশব্দে হাসল রিমি। হামজা একেবারে পেচিয়ে ধরে ফেলার আগেই একলাফে গা ঝেরে উঠে সরে দাঁড়াল। হামজা আধশোয়া হয়ে বসে বলল, “রিমি! দরজা আটকে দিয়ে এসো!ʼʼ


-“পারব না।ʼʼ


হামজা একটা মোটা বই তুলে নিলো হাতে। এখন অভ্যাসবশত চশমা চোখে এঁটে ভারী বইখানা পড়তে বসার কথা। তা না করে ধমক দিলো, “আমি উঠে গিয়ে ধরলে কাল সকালে তোমার খবর 'আমাদের সময়ʼ পত্রিকায় বের হবে, আমাকে টলারেট করতে পারবেনা কিন্তু! অবাধ্যতা পছন্দ না আমার।ʼʼ


নাক কুঁচকাল রিমি, “ছিহ! কী মুখের ভাষা! আমি আপনার পার্টির মেম্বার না, বউ আপনার! আপনার পছন্দ অপছন্দ আমার কাছে চলবে না।ʼʼ


হামজা বই রেখে ফোন হাতে নিয়ে বালিশ খাঁড়া করে তাতে পিঠ হেলান দিয়ে বসল। ফোন কানে ধরে রিমির উদ্দেশ্যে বলল, “পালাতে পারবে নাকি?ʼʼ 


ওপাশ থেকে কল রিসিভ করল জয়, “হ্যাঁ, সাহেব!ʼʼ


-“কোথায় তুই? রাত বাজে কয়টা?ʼʼ


-“দেরি হবে আসতে। ক্লাবে আছি।ʼʼ


-“ক্লাবে কী করছিস?ʼʼ


-“ক্যারাম খেলছি।।ʼʼ


-“ঢকঢক করে গিলছে কে?ʼʼ


-“আমার নাম জয়। ভদ্রনাম–জয় আমির।ʼʼ


-“জেনে আনন্দিত ও উপকৃত হলাম।ʼʼ


-“সাহেব, আপনি বাসায় গেলেন কখন? মামা এসেছে বাসায়?ʼʼ


রিমি এসে কাছে দাঁড়াতেই এক হেচকা টান দিয়ে ফেলে দিলো বিছানায় ওকে। দাড়ি-গোফের মুখটা গলায় ঠেকাল। একহাতে রিমিকে শক্ত করে বিছানার সাথে চেপে ধরে রেখে, অপর হাতে ফোন কানে ধরে বলল, “আসেনি এখনও! তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়। দুপুরের পর পৌরসভায় কাজ ছিল, যাসনি। আমার হাতে থাপ্পড় খাসনি বহুদিন! ঘন্টাখানেকের মধ্যে বাড়িতে পা পড়ে যেন! নয়ত থাপড়ে ত্যাড়ামি সোজা করে দেব।ʼʼ


কলটা কেটে দিলো জয়। হামজা রিমির দিকে তাকিয়ে বলল, “স্বামীর খেদমতে গাফলতি করতে নেই, জানো না? এই অবাধ্যতা মেনে নেব না আমি।ʼʼ


রিমি হামজার খোলা পিঠ খামচে ধরল, “জয়কে এতো প্রশয় কেন দেন আপনি? ওকে খারাপ করার পেছনে শতভাগ হাত আপনার রয়েছে। এটা কি ওর ভালো চাওয়া, নাকি ওকে ধ্বংস করা?ʼʼ


হামজা রিমির ঠোঁটের এক কিনারে আলতো একটা চুমু খেয়ে বলল, “ধ্বংস আর সৃষ্টির মাঝে যে দেয়ালটা, তা খুব মসৃণ, রিমি! বলতে পারো, মুদ্রার এপিট-ওপিঠ। পদার্থ একই, শুধু পাশ বিপরীত। জয় স্বাধীনচেতা ছেলে, ও জীবনকে যেভাবে ইনজয় করতে চাচ্ছে, আমি ওকে সেভাবে চলতে বলিনি। ও যা করে, শুধু বাঁধা দিতে ইচ্ছে হয়না ওর কোনো কিছুতে। দেখোনা, ও যখন শব্দ করে হাসে, দেখতে আর শুনতে কী চমৎকার লাগে!  তার চেয়েও বড়ো কথা, দিনশেষে আমি শুদ্ধ নই।ʼʼ


সকাল সাতটা বাজল অন্তূর ঘুম থেকে উঠতে। ফাইনাল এক্সাম কাছে এগিয়ে আসছে, রাত জেগে পড়তে হয়। মাঝেমধ্যেই অন্তূর ইচ্ছে করে, একরাতে যদি অনার্সের এই চার বছর শেষ হয়ে যেত, আর সে আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে যেত স্নাতক করতে! তার কিছুদিন পর উকিলের ওই সাদা-কালো পোশাকটা গায়ে চড়াতে পারতো! 


দ্রুত অযু করে এসে ফজরের নামাজে বসল। আম্মা উঠেছে, রান্নাঘর থেকে ঠুকঠাক আওয়াজ আসছে। 


বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বড়ো বড়ো কচুরিপানা জন্মেছে পুকুরে। আজ আর ডাহুক পাখির দেখা পেল না। গ্রিল ধরে দাঁড়াল। মাথায় সারাটা প্যাচ কাটে আজকাল। সকাল থেকে শুরু হয়, গভীর রাতেও শেষ হবার নাম নেয় না। আব্বুর কাছে গতরাতে জিজ্ঞেস করেছিল অন্তূ, হামজা পাটোয়ারীর ব্যাপারে। 


হামজা ভার্সিটির ছাত্রলীগ সংগঠনের নেতাকর্মী। তার অনেক উন্নয়নমূলক কাজের নজির আছে জেলায়! বাপের কাউন্সিলর হবার পেছনে তার বিশেষত্ব রয়েছে। তার বাপকে কেউ ভোট দিতো না কোনোকালে, তার বদৌলতে ভোট পেয়ে কাউন্সিলর হয়েছেন হুমায়ুন পাটোয়ারী। 


হামজা চতুর এবং বাহ্যিক নিখুঁত চলনের এক তরুণ রাজনীতিবিদ। সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষের কাছে তার নাম ভগবানের মতোই, তারা জপে বেলায় বেলায়! আবার তরুণদের কাছেও বেশ সমাদৃত! তবুও কোথাও যেন ঘাপলা রয়ে গেছে তার মাঝে! ক্ষমতার নেশা নেশার পিছনে খুব ক্ষিপ্রগতিতে ছুটছে হামজা। এবার বাবাকে কাউন্সিলর পদ থেকে সরিয়েছে। চাইলে হুমায়ুন পাটোয়ারী আবারও কাউন্সিলর এবং নিজে মেয়র হতে পারতো। জেলার দুই সমাজসেবক নেতাকর্মী পাটোয়ারী পরিবারেই থাকতো। তা করেনি হামজা। এখানেই হামজাকে চতুর এবং ক্ষুরধার এক রাজনীতিবিদ বলার সুযোগটা আসে। 


সে যা নাম কামিয়েছে জনসাধারণের কাছে, তা থেকে অনায়াসে বাপ-ছেলে পদপ্রার্থী হলে জিতে যেত দুজনেই।কিন্তু সে এখানে মানুষের মাঝে একটা কৃতজ্ঞতাবোধের জায়গা রেখেছে যে, হামজা সুযোগ এবং ক্ষমতা থাকতেও তা কাজে লাগিয়ে পদ নেয়নি। বরং সে শুধুই সমাজসেবকের ভূমিকায় অধিষ্ঠিত হতে চায়। 


কথাগুলো শুনে অন্তূর মনে হলো, নিঃসন্দেহে হামজা রাজনীতিবিদ হিসেবে চরম ধূর্ত চাল-চলনসম্পন্ন। তাহলে মানুষ হিসেবে কেমন? এটাও নিশ্চিত প্রায়, হামজা জিতে যাবে এবার। অন্তূকে আব্বুকে জিজ্ঞেস করল, “এরপর সরাসরি সংসদ নির্বাচন করবে তাই তো?ʼʼ


আমজাদ সাহেব হাসলেন, “তাই তো করার কথা। মশারী টাঙিয়ে দিয়ে আয় তো আমার ঘরে। প্রেশারের ওষুধ খেয়েছি, ঘুম আসছে।ʼʼ


সে এতদিন যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছে, সেখানে মনে হয়েছিল ওই পরিবারকে তার মতোই সবাই ঘৃণা করে।  এখন মনে হচ্ছে, শুধু মাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ ওই পরিবারকে দোষারোপ অবধি করবেনা। অর্থাৎ, আঁখির পরিবার দ্বিধায় রয়েছে, সাথে সেও। সে ঝুলে আছে জয়ের পক্ষ থেকে আসা সম্ভাব্য একশনের জন্য। আবার মনে হচ্ছে, জয় কিছুই করবেনা। করলে করতো তো!


হামজা বিয়ে করল, মেয়র সাহেবের ছোটো ভাইয়ের মেয়ে রিমি আহসানকে। মেয়রের ভাই ফারুক আহসানের সঙ্গে কীসের এক আলোচনা বেঠকে গিয়ে প্রথম দেখেই রিমিকে পছন্দ হয়েছিল। তরুণ নেতাকর্মী হিসেবে ভালো নাম এবং প্রতিপত্তি তো কামিয়েছে হামজা এই বয়সেই। 


তার নাম খারাপ করার জন্য আছে একজন, যাকে সে খুব যত্নে পালছে— জয় আমির। হামজার ফুফাতো ভাই। জয়ের বেপরোয়া কার্যক্রম সকলের কমবেশি জানা। তবুও সে ভার্সিটির ছাত্রদলের লিডার। কেন, কীভাবে এটাও ভাবার বিষয়! তা যদি ছাত্রদের কাছে জিজ্ঞেস করা যায়, তারা সমস্বরে স্বীকার করবে, তাদের নেতাকর্মীকে খুব পছন্দ তাদের! জয় ভালো লিডার তাদের। তার চঞ্চলতা এবং দুষ্টুমি ছাড়া আর কিছু একটা অবর্ণনীয় রয়েছে, যেটা আকর্ষণীয়। দায়িত্বজ্ঞানহীন বলা চলে না। রাজনৈতিক কাজকর্মে যেমন ষোলো আনা, দুষ্টু কাজেও সে ব্যাপক পারদর্শী। 


সামনেই পৌরসভা নির্বাচন আসছে। বাপের বদলে হামজা নির্বাচনে অংশ নেবে, এই রব মুখে মুখে উঠে গেছে। সরাসরি ছাত্রনেতা থেকে সাংসদ নির্বাচনের বিষয়ে বিভিন্ন জনরব ছড়িয়েছিল তার নামে। চতুর হামজা এতো তাড়াতাড়ি এতদূর উড়ার মতো বোকামি করবে না। সংসদ নির্বাচনকে হাতে রেখে আপাতত সে এবারের মেয়র পদপ্রার্থী। 


অন্তূর রাজনৈতিক বিষয়াদিতে আগ্রহ ও বিদ্বেষ দুটোই সমান। সাথে রয়েছে সমাজ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা। নিজের নামের সামনে যেকোনো মূল্যে অ্যাডভোকেট যুক্ত করার প্রয়াসে দৌঁড়ে চলেছে সে। তার জন্য তার সমাজ, রাষ্ট্র, অপরাধ, কূটনীতি, রাজনীতি, সুনীতি, দূর্নীতি—সব জানা চাই, সব।


কাউন্সিলর সাহেব চাঁদনীকে বলেছিলেন, টাকা নেবেন। সেদিন রাতেই সেই টাকা কেউ বা কারা এসে লুটে নিয়ে গেল। এর মধ্যে কাউন্সিলর এবং তার ছেলে হামজার হাত থাকাটা অসম্ভব নয়। তবে, কেউ যদি নিজের আবাস ছেড়ে উঠতে না চায়, টাকা দিয়ে বিক্রিত বাসভূমি ফেরত নিতে চায়, তাহলে তার বিনিময়ে এত জঘন্য প্রতিদান কোনো সুস্থ মানুষ দেবে না। হুমকি দিতে পারতো, তুলে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে শর্ত দিতে পারতো! অথচ অমানুষিক বর্বরতা একটা মেয়ের সাথে! আসলে ঘটনা কী?


গেইট দিয়ে সরাসরি ঢুকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগটা পড়ে একপাশে একটু ভেতরে। গাছপালায় ছেয়ে আছে বিল্ডিংয়ের আশপাশের চত্বরটা। কেউ একজন পেছনে এসে খুব কাছে দাঁড়িয়ে তার নাম ধরে এমনভাবে ডাকল, যেন বহুদূর থেকে গলা উঁচিয়ে ডাকছে। ম্যান পারফিউমের কড়া গন্ধটা! চমকে উঠে ছিটকে দূরে সরিয়ে দাঁড়াল অন্তূ, “আরমিণ!ʼʼ


ডাকটা শুনতে এমন লাগছে যেন বহুকালের পরিচিত, এবং ডেকে অভ্যস্ত জয়! অন্তূ নির্বাক চোখে চেয়ে দেখল। খুব কাছে এসে দাঁড়াল জয়, “কুত্তা দেখে ভয় পাও দেখছি, সিস্টার! চ্যাহ! আমি কাহিনি ঠিক বুঝলাম না। একদিন কুকুরকে সিনিয়রের সংজ্ঞা শেখাও, আরেকদিন ভয়ে কুঁকড়ে যাও, ব্যাপার কী?ʼʼ


অন্তূ জবাব দিলো না। জয় ঘাঁড় বাঁকা করে দেখল অন্তূকে। যেন ওর মুখে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু খুঁজছে। 


-“জবাব দিচ্ছ না কেন?ʼʼ 


-“ইচ্ছে করছে না।ʼʼ


জয় বুকের ডান পাশে হাত চাপলো, “ঠুকছো ডিয়ার। উফফফ, পেইন!ʼʼ


কবীর কানে কানে বলল, “ভাই, হৃদপিণ্ড বামে থাকে।ʼʼ


-“আমরাটা বিশাল বড় হে শালা। ডান-বামে ছড়ায়ে-ছিটায়ে একাকার। চুপ থাক।ʼʼ


কবীর কপাল ঠুকলো।


অন্তূর মুখের ওপর নজর আটকে হেসে ফেলল চট করে জয়, “জানো! আমি সিংহ বা বাঘ নই! খপ করে থাবা দিয়ে শিকার ধরি না, কারণ আমি বাহাদুর না! তোমার ভাষ্যমতে কুকুর আমি। কুকুরের অনেকগুলো স্পেসিফিক স্বভাব থাকে! তার মধ্যে একটা হলো, ছ্যাঁচড়ামি। আমি কুকুরের সেই স্বভাবের অনুসারী। কৌশলে ধীরে সুস্থে নির্লজ্জতার সাথে ধরব তোমায়, তুমি ঝরঝর করে ঝরে পড়বে। বুঝতে পারিচো?ʼʼ 


অন্তূর বুকটা কাঁপল। জয়ের মুখের নির্বিকার ওই হাসি গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। শান্ত, স্বাভাবিক স্বরে বলছে কথাগুলো! লোকে জয়কে পাশ কাটাচ্ছে, সালাম ঠুকছে, কেউ হাত মেলাচ্ছে। 


-“আমার এলাকায় গেছিলে কেন সেদিন?ʼʼ


যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। এবারেও জবাব দিলো না অন্তূ। জয় অন্তূর দিকে ফিরল, “কেন গেছিলে?ʼʼ


অন্তূ কথা বলল না। সুন্দর দৃষ্টি মেলে তাকাল জয়। সুন্দর করে বলল, “ইচ্ছে করছে একটানে তোর নেকাবটা খুলে ছিঁড়ে ফেলি, শালী। ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে খুব কাঁচা আমি। কেন গেছিলি ওইদিকে?ʼʼ


ধৈর্যতে মানল না জয়ের কথাটা। এত আত্মমর্যাদাহীন হওয়ার সাহস নেই অন্তূর। নিজের ধিক্কারে মরে যাবে সে।


-“গেছিলাম। কী করবেন? ফাঁসি দেবেন? অথবা রেস্ট্রিকশন দেবেন, আমি কী কী করতে পারব, না পারব?ʼʼ


কেমন করে যেন হেসে ফেলল জয়, “ছিহ! তা দেব কেন? জিজ্ঞেস করছি কেন গিছিলে? রেগে যাচ্ছ কেন?ʼʼ


জয়ের হাসিতে গা শিউরে উঠল অন্তূর। ক্যাম্পাস ভর্তি লোক, বেইজ্জতমূলক কিছু না ঘটুক, তা সামলাতে এতক্ষণ চুপ ছিল। এবার আর হলো না। অন্তূ বলল, “ঘুরে দেখতে গেছিলাম।ʼʼ


-“ভিক্টিমের বাড়ি?ʼʼ


অন্তূ হাসল, “এবার সন্দেহ গাঢ় হচ্ছে আপনাদের ওপর।ʼʼ


হতাশাজনক শ্বাস ফেলল জয়, “হাহ! ইনভেস্টিগেশনে নেমেছ তাহলে! তাতে তোমার প্রোফিট কী? আর আমাকেই বা দোষী করতে চাইছ কোন সুখে? আচ্ছা বাদ দাও সেসব। বলো, সন্দেহ সত্য হলে কী করবে?ʼʼ


-“কিছুই করার নেই?ʼʼ


-“নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু কী করার আছে?ʼʼ


অন্তূ দৃঢ় চোখে চেয়ে বলল, “সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করুন, তিনি ছেড়ে দেন না।ʼʼ


জয় মাথার উপরে হাত তুলে আলস্য ভঙ্গিতে বলল, “ধরেও তো না! আছে তো সৃষ্টিকর্তা, না!ʼʼ


অন্তূর মুখটা কুঁচকে এলো ঘৃণায়, “তিনি ধরলে আর পালানোর পথ পাবেন না।ʼʼ


জয় হাসল, “আচ্ছা আচ্ছা! সেরকম সৃষ্টিকর্তা টাইপের কিছু থাকলে তাকে বলো দ্রুত আমায় ধরতে। পুলিশই ধরুক অন্তত। বেশিদিন পুলিশের সাথে রেষারেষি না থাকলে নিজেকে খুব দূর্বল লাগে! তুমি প্লিজ কিছু একটা করো, যাতে আমাকে পুলিশ ধরে। আর তুমি নিজের চেয়ে বেশি আমার চিন্তা করছো, প্রেমে পড়েছ আমার?ʼʼ


অন্তূ কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে রইল জয়ের চেহারার দিকে। গোল বা লম্বা আখ্যা দেয়া যায়না চেহারাকে। ফর্সা বা কালোও নয়, শ্যামলাও নয়! তামাটে ইট রঙা চেহারা। নাকটা সরু, হাসিটা অদ্ভুত, জড়ানো। পরনে সাদা ধবধবে লুঙ্গি। পায়ে চাড়ার বেল্টওয়ালা স্যান্ডেল। তার বেল্ট আটকায়না কখনও জয়। গলায় চেইন ঝুলছে, তাতে ইংরেজি 'Jʼ লেটার লকেট হিসেবে রয়েছে। বাম হাতে আজ রিস্টলেটের বদলে একটা রূপালি বালা, ডানহাতে ঘড়ি পরেছে। কী বিশ্রী অদ্ভুত! চুলগুলো ফেঞ্চকাট, সুবিন্যস্ত। 


অথচ জয়ের আজব মুগ্ধ হবার মতো চেহারা এবং গড়নে অন্তূর ঘেন্না উতলে এলো। বলল, “কী করবেন আপনি আমার? কী করেছি আমি? কীসের নোংরা খেলায় মত্ত হবার পরিকল্পনা নিয়ে বসে আছেন?ʼʼ


জয় হেসে ফেলল, “ভয় পাচ্ছ, আরমিণ?ʼʼ


-“জি পাচ্ছি।ʼʼ


-“কেন কেন?ʼʼ


-“ভয় পাওয়া উচিত। আপনার মতো নোংরা মানসিকতার মানুষের কাছে একটা মেয়ে ভয় না পেলে চলবে কেন?ʼʼ


জয় শান্ত স্বরে বলল, “তুমি এসেছ আমায় খুলতে, আমি গেছিলাম না আমার রঙ দেখাতে তোমার কাছে। সেদিন আমার দেয়া সিগারেট তুমি পায়ে পিষে চলে গেলে? যাক, ধরো নির্বাচনের ঝামেলায় সেটা নাহয় ভুলে যেতাম। তুমি কাল গেছিলে ওই বাড়িতে। কেন? আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করতে?ʼʼ


-“শিক্ষিত মানুষ মূর্খের মতো অযৌক্তিক কথা বলবেন না, বেমানান লাগে। খারাপ লেগেছিল পরিবারটার জন্য, দেখতে গেছিলাম মাত্র।ʼʼ 


-“এইজন্যই কয়, মাগী মাইনষের নাই বারো হাত কাপড়ের কাছা। বোঝেনা বাল, ছিঁড়তে যায় ডাব গাছের ছাল।ʼʼ


অন্তূ অস্বস্তিতে একটু চেঁচিয়ে উঠল, “রহস্য করবেন না। সোজা করে বলুন, কাহিনী কী?ʼʼ


জয় আশপাশে তাকিয়ে বলল, “গলার আওয়াজ উচু যেন না হয়, খেয়াল রেখো।ʼʼ 


পা দিয়ে মাটিতে থাবা দিয়ে ইশারা করল, “এই মাঠে কবর দিয়ে দেব একদম! আরমিণ, তুমি বলো, তুমি কী চাও?  আমার বিপরীতে খেলে পারবে, তুমি?ʼʼ


রাতে সবাই শুয়ে পড়লে অন্তূ পড়ার টেবিলে বসল। পড়ায়  মনোযোগ পাচ্ছিল না। নানান চিন্তা। 


দরজায় ধাক্কা পড়ল। ধাক্কাটা কার বুঝল অন্তূ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার খুলল। মার্জিয়া ভেতরে এসে অন্তূকে জিজ্ঞেস করল, “পড়ালেখার কী খবর তোমার?ʼʼ


-“ভালোই। বসুন আপনি।ʼʼ


বসল মার্জিয়া, খুব আন্তরিক স্বরে বলল, “শোনো, তুমিও তো আমার বোনের মতোই! তুমি আমায় যতটা পর ভাবো, আমি কি আসলেই অতটা খারাপ?ʼʼ


-“জি না, অতটা খারাপ না।ʼʼ


-“তার মানে একটু খারাপ?ʼʼ একটু হাসল মার্জিয়া।


অন্তূ বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইপত্র তুলে নিয়ে গিয়ে টেবিলে সাজাতে সাজাতে বলল, “কী বলতে এসেছেন?ʼʼ


-“এমনি আসতে পারি না?ʼʼ


-“অবশ্যই পারেন। তবে এমনি আসেননি।ʼʼ


-“তোমার তো অনার্স সেকেন্ড ইয়ার শেষের দিক। তোমার প্রতি একটা দায়িত্ব আছে তো নাকি? 


-“আছে তো।ʼʼ


-“তোমাকে এসে আমার ছোটো বোনের মতো পেয়েছি, সেই হিসেবে তোমার ভবিষ্যত নিয়ে ভাবার অধিকার আছে না? 


-“জি, আছে।ʼʼ


-“তুমি নিজে এখন তো একটু ভাবতে পারো..ʼʼ


-“জি ভাবছি। ভাবছি আমি বিয়েশাদীর কথা। মনের মতো পেলে বিয়ে করে নেব। আপনি এতো টেনশন করবেন না, ভাবী।ʼʼ


মার্জিয়া এক পলকের ব্যবধানে চেতে উঠল, “তোমার মনের মতোন ছেলে ফ্যাক্টরিতে অর্ডার দিয়ে বানায়ে আনি, কী বলো? তোমার মনের মতো কোনো ছেলেও আছে এই আল্লাহর দুনিয়ায়?ʼʼ


অন্তূ একটাও কথা বলল না। বই গোছাতে থাকল। 


-“কীরকম চাও তুমি? যে তোমার এইসব কটকটে শক্ত কথা মেনে, বিলাইয়ের মতোন তোমার পিছপিছ চলবে এইরকম চাও তো তুমি! তোমার মতো মেয়েকে কোনোদিন কেউ বিয়ে করে নিয়ে বাড়ি তুলবে না। ছেলে মানুষ কি গোলাম? কামাই রোজগার করে খাওয়াবে, আবার তোমার আলগা ভাব দেখবে? ভাব দেখে বাঁচি না আমি তোমার।ʼʼ


অন্তূ স্বাভাবিক স্বরে বিনয়ের সাথে বলল, “মরেও তো আর যাচ্ছেন না, তাই না! আপনি আপনার ঘরে থাকেন, আমি আমার ঘরে। এমন নয় সবসময় আমার ভাব আপনার চোখের সামনে থাকে। সামনে আসলেও চেষ্টা করবেন, চোখ বুজে অথবা দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাখতে। দেখবেন, আর আমার ভাব আপনার চোখে পড়ছে না। আর এমন তো মোটেই নয়, যে আপনার অথবা আপনার স্বামীর কামাই খাচ্ছি এ বাড়িতে। তাহলে আপনার আসলে ব্যথাটা কোথায়?ʼʼ


নাক শিউরে উঠল মার্জিয়ার। সর্বোচ্চ রাগটা মার্জিয়ার ওঠেই অন্তূর সুবিন্যস্ত ভঙ্গিমায় শান্ত স্বরে বলা দায়সারা কথাগুলোতে। 


রি রি করে উঠল সে, “মরিনি এই নিয়ে আফসোস তোমার! আবার ব্যথা!ʼʼ


-“জি, না। আফসোস নেই। ভুল বুঝছেন আপনি। কথার পেক্ষিতে বলেছি। শান্ত হোন। রাত অনেক, চেঁচালে লোকে খারাপ বলবে।ʼʼ


-“এই ব্যথা কী, হ্যাঁ? তোমার মুখে জুতা মারা উচিত! আজ কয়দিন আমার শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না, আবার কিছু করে আসছো কবিরাজের কাছে আমার জন্য নিশ্চয়ই! যাতে তাড়াতাড়ি মরি, এইটাই তো বুঝাইলা তোমার কথার মাধ্যমে!ʼʼ


-“আপনার আমাকে সমস্যাটা কী?ʼʼ


দাঁত খিঁচিয়ে উঠল মার্জিয়া, “তোমাকে নিয়ে সমস্যা যে কোথায়, সেটা তো আমি নিজেও বুঝি না! আসলে তোমার ভাব আমার সহ্য হয়না, অন্তূ! ওইটাই আমার সমস্যা। তোমার কথাবার্তা সহ্য হয়না আমার। বাড়ির যে অবস্থা, তার ভেতরে জান দিয়ে পড়ালেখা করা। এইটাও সহ্য হয়না।ʼʼ


অন্তূ ঘাঁড় নাড়ল। সে বুঝেছে।


-“শোনো, কাল আমার চাচাতো ভাইয়ের বাড়ির লোক আসতেছে তোমায় দেখতে। যদি কোনো উল্টাপাল্টা করো, আর আমি বাপের বাড়ি চলে যাই, তোমার ভাই যে তোমাদের শান্তি রাখবে না, তা জেনে রাখো।ʼʼ


-“ভাই আমাদের কিছু বলবে না, ভাবী। আপনাকে গিয়ে নিয়ে আসবে ও বাড়ি থেকে।ʼʼ


দিনকাল ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে। চারদিক সংকটময়, সংকীর্ণ হয়ে উঠছে। ভাবীর আচরণ দিনদিন রহস্যময় আর আরও উগ্র হয়ে উঠছে। 


আমজাদ সাহেব খুব গম্ভীর আর শীতল মানুষ, শিক্ষিত মানুষটার ব্যক্তিত্ব প্রখর। তাতে দাগ না লাগাতে তিনি সব করবেন। অন্তূ কথা বলে, অথচ আমজাদ সাহেবের নীরবতার মাঝেই যেন যত তেজ নিহত।


কাল আব্বুর কাছে একজন পাওনাদার এসে বসে থেকে গেছে ঘন্টাখানেক। আব্বু লোকটাকে বেশ তোষামোদ করছিল, যেটা আব্বুর আত্মমর্যাদার খেলাপি অনেকটাই! লোকটার মুখে সন্তুষ্টি নেই, অথচ আব্বু ক্রমাগত চেষ্টা করছিল লোকটাকে একটু খুশি করার, দুটো দিন সময় চেয়ে নেবার। ভালো লাগেনি অন্তূর। আঁখির কথা মাথায় এলো আবার, এভাবেই সময় চেয়েছিল নিশ্চয়ই আঁখির পরিবার! আচ্ছা, আঁখির এই বিভৎস অবস্থার পেছনে এ ছাড়াও কি আরও কিছু আছে?


ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তার পাগল পাগল লাগে আজকাল। না! এভাবে এটুকুতেই হয়রান হলে তার নামের পাশে অ্যাডভোকেট উপাধি মানাবে না আগামী কালে! তাকে সবকিছুতে স্বাভাবিক থাকার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সে চেষ্টা করছে তা-ই। আঁখির ডেডবডির কথা মাথায় আসলেই ভেতরে ভেঙেচুড়ে আসে, মাথায় ভয়াবহ চাপ পড়ে, প্যানিক এসে জড়ো হয়! আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ে ভেতরের নারীসত্তাটা। মানসিক ভারসাম্য হারানোর জোগাড় হয়, তবুও শান্ত রেখেছে নিজেকে। এই দুনিয়ায় ভঙ্গুর হওয়া যাবে না, একুটুও না।


চলবে..

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভালোবাসার গল্প | অবরুদ্ধ নিশীথ | পর্ব - ০৫ এই পোস্ট টি পড়ার জন্য। আপনাদের পছন্দের সব কিছু পেতে আমাদের সাথেই থাকবেন।

Post a Comment

Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.
A+
A-
দুঃখিত লেখা কপি করার অনুমতি নাই😔, শুধুমাত্র শেয়ার করতে পারবেন 🥰 ধন্যবাদান্তে- আদুরি পাখি